মধ্যযুগে ভারতের সংস্কৃতি পর্ব ৪ | শিক্ষা, দর্শন ও খাদ্যসংস্কৃতি

মধ্যযুগে ভারতের সংস্কৃতি পর্ব ৪ | শিক্ষা, দর্শন ও খাদ্যসংস্কৃতি

📖 পূর্ববর্তী পর্বগুলো পড়ুন:

মধ্যযুগে ভারতের শিক্ষা, দর্শন ও খাদ্যসংস্কৃতি

মধ্যযুগে শিক্ষা ব্যবস্থা

মধ্যযুগে ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা ধর্ম ও আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাবেই গঠিত হয়েছিল। হিন্দু সমাজে গুরুকুল, টোল এবং পাঠশালায় সংস্কৃত ভাষাভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া হতো, যেখানে ধর্ম, ন্যায়শাস্ত্র, দর্শন ও কাব্য ছিল প্রধান বিষয়। পাঠশালাগুলো সাধারণত ব্রাহ্মণদের অধীনে পরিচালিত হতো এবং নিম্নবর্ণের প্রবেশাধিকার সেখানে সীমিত ছিল।

অপরদিকে মুসলিম সমাজে গড়ে ওঠে মক্তব (প্রাথমিক বিদ্যালয়) ও মাদ্রাসা (উচ্চতর শিক্ষাকেন্দ্র)। সেখানে আরবি ও ফারসি ভাষায় ধর্মতত্ত্ব, আইনশাস্ত্র, ইতিহাস, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখানো হতো। দিল্লির মাদ্রাসা-ই-নাসিরিয়া ছিল অত্যন্ত নামকরা এক প্রতিষ্ঠান।

মুঘল আমলে শিক্ষা ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়। আকবর সম্রাট ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানান তার সভায়। তিনি ‘ইবাদতখানা’ নামে একটি আলোচনাকেন্দ্র স্থাপন করেন যেখানে হিন্দু, মুসলিম, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ মতবিনিময় করতেন।

দর্শনচর্চা ও মতবাদ

মধ্যযুগে দর্শনচর্চা প্রধানত দুই ধারায় চলেছে — হিন্দু শাস্ত্রীয় দর্শন এবং ইসলামি সুফি দর্শন। বেদান্ত, মীমাংসা, যোগ ও ভক্তি দর্শন হিন্দু সমাজে প্রভাব বিস্তার করে। শঙ্করাচার্য অদ্বৈত দর্শন প্রচার করেন, আবার রামানুজ ও মাধবাচার্য বিশিষ্টাদ্বৈত ও দ্বৈত মতবাদের মাধ্যমে ঈশ্বর ও আত্মার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন।

সুফি সাধকগণ একাধারে আল্লাহর প্রতি আত্মিক প্রেম এবং মানবিক মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব দেন। তাদের দর্শনে ভেদাভেদহীন মানবতাবাদ, আত্মসংযম, সাধনা ও আল্লাহর সঙ্গে মিলনের তত্ত্ব আলোচিত হয়। সুফিদের দর্শনে “হৃদয়ের শুদ্ধতাই আসল জ্ঞান” — এই ভাব ধ্বনিত হয়।

মধ্যযুগে জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব কমে আসলেও দক্ষিণ ভারতে কিছু অঞ্চল ও রাজদরবারে এই চিন্তাধারাগুলোর অস্তিত্ব টিকে ছিল।

খাদ্যসংস্কৃতি ও আচার

মধ্যযুগের ভারতীয় খাদ্যসংস্কৃতি ধর্ম, ভৌগোলিকতা ও সামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। হিন্দু সমাজে নিরামিষ আহারের প্রচলন ছিল, বিশেষ করে ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব ঘরানায়। চাল, ডাল, সবজি, দই, ফল এবং ঘি প্রধান খাদ্য উপাদান ছিল।

মুসলিম সমাজে মাংস, বিরিয়ানি, কাবাব, কোর্মা, শিরকুরমা, হালিম, নানা রকম মিষ্টান্ন— যেমন শাহী টুকড়া, জর্দা ইত্যাদির প্রচলন ঘটে। পারস্য, আফগান ও তুর্কি প্রভাবময় এই খাবার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ভারতীয় রান্নায় মিশে যায়।

বাঙালি সমাজে মাছ ও ভাত ছিল প্রধান খাদ্য। বৌদ্ধদের প্রভাবে নিরামিষাশী ধারা এবং সুফিদের দান-ভোজন প্রথা খাদ্যসংস্কৃতিকে সহানুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে দেয়। মন্দির এবং দরগার সঙ্গে যুক্ত খাবার যেমন — প্রসাদ ও তবরুক — একধরনের সামাজিক সংহতির প্রতীক হয়ে ওঠে।

সংস্কৃতি ও খাদ্যের সংমিশ্রণ

খাদ্য ও সংস্কৃতির মিলনস্থল ছিল উৎসব ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ঈদ, দুর্গাপূজা, মহরম, রাসলীলা বা উরস উৎসবে জাতি–ধর্ম নির্বিশেষে খাদ্য ভাগাভাগির মাধ্যমে এক সামাজিক ঐক্য গড়ে ওঠে। মন্দিরে অন্নপ্রাশন, দান, দরগায় লঙ্গর বা পবিত্র রান্না মধ্যযুগীয় ভারতকে এক বহুধর্মীয় ও বহুসাংস্কৃতিক সমাজে রূপান্তর করে।

📌 শেষ পর্বে পড়ুন: মধ্যযুগীয় ভারতের সংস্কৃতির সামগ্রিক মূল্যায়ন ও উত্তরাধিকার

লেবেল: মধ্যযুগ, ভারতের সংস্কৃতি, শিক্ষা, দর্শন, খাদ্য, ইতিহাস, সুফি দর্শন, গুরুকুল, মাদ্রাসা, সমাজবিজ্ঞান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...