মধ্যযুগে ভারতের সংস্কৃতি পর্ব ৩ | সংগীত, বিজ্ঞান ও নারীর অবস্থান
মধ্যযুগে ভারতের সংস্কৃতি পর্ব ৩ | সংগীত, বিজ্ঞান ও নারীর অবস্থান
📖 পূর্ববর্তী পর্বগুলো পড়ুন:
ভক্তি ও সুফি সংগীতের উত্থান
মধ্যযুগে সংগীত ছিল ধর্মীয় ভাবপ্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম। হিন্দু ভক্তি আন্দোলনের সাথে যুক্ত সাধুরা সংগীত ও পদাবলীর মাধ্যমে ঈশ্বরভক্তি প্রচার করতেন। চৈতন্যদেব, তুলসীদাস, নামদেব প্রমুখ ধর্মগুরুরা কীর্তন, ভজন, অভঙ্গ ও পদাবলী গান প্রচলন করেন। এই গানগুলো সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য হওয়ায় ভক্তিবাদ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
অপরদিকে, সুফি সাধকগণ সংগীতকে আল্লাহর প্রতি আত্মিক প্রেম প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। কাওয়ালি, হামদ, নজম ও ঘজল প্রভৃতি রচনার মাধ্যমে সুফি দর্শন প্রচারিত হয়। কাওয়াল আমির খুসরু ছিলেন সুফি সংগীত ও হিন্দুস্তানি সংগীতের সেতুবন্ধনকারী। তার রচনায় পারস্য ও ভারতীয় ধারার মেলবন্ধন ছিল অসাধারণ।
মধ্যযুগে সংগীতচর্চা রাজসভা ও দরবারেও প্রচলিত ছিল। মুঘল দরবারে বাদশাহ আকবর নিজে সংগীতপ্রেমী ছিলেন। তার সভাসদ তানসেন হিন্দুস্তানি ক্লাসিকাল সংগীতের অন্যতম ভিত্তি স্থাপন করেন। এই সময় ধ্রুপদ, ধামার, কায়াল ইত্যাদি ধারার বিকাশ ঘটে।
নৃত্যশিল্প
নৃত্যশিল্প মধ্যযুগে ধর্মীয়, শাস্ত্রীয় ও লোকজ ধারায় বিকশিত হয়। ভরতনাট্যম, কত্থক, ওড়িশি ও কুচিপুড়ির মতো ধ্রুপদী নৃত্যধারাগুলোর শৈল্পিক এবং আধ্যাত্মিক গুরুত্ব ছিল। মন্দিরে দেবদাসীদের নৃত্য ছিল পূজার একটি অঙ্গ। পাশাপাশি লোকনৃত্য যেমন — ছউ, কালি, গারবা, এবং বাউল ঐতিহ্য ভারতীয় সংস্কৃতিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি
যদিও মধ্যযুগকে প্রায়শই “অন্ধকার যুগ” বলে চিহ্নিত করা হয়, তবু ভারতীয় উপমহাদেশে এ সময় বিজ্ঞান, গণিত ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য কিছু অগ্রগতি হয়। আলবেরুনি, আবু নাসর, ও আবুল ফজল প্রমুখ মুসলিম পণ্ডিতগণ জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল ও ইতিহাস বিষয়ে বিশদ রচনা করেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে “চরক সংহিতা” ও “সুশ্রুত সংহিতা”-র সঙ্গে ইসলামী ইউনানি চিকিৎসার মেলবন্ধন ঘটে। জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে ভারতীয় ও পারস্য পদ্ধতির সংমিশ্রণে নবনব তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়। তবুও ধর্মীয় গোঁড়ামি, জাতপাত প্রথা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী শিক্ষার সংকীর্ণতা গণবিজ্ঞানের বিস্তার ব্যাহত করে।
তবে রাজসভায় কিছু জ্যোতির্বিদ ও চিকিৎসক উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। মুঘল সম্রাটরা জলঘড়ি, জ্যোতির্বিদ্যার মানচিত্র ও গ্লোব ব্যবহার করতেন। হুমায়ুন ও আকবর বিজ্ঞানী ও কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
নারীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান
মধ্যযুগে নারীর অবস্থান ছিল দ্বৈত প্রকৃতির। একদিকে নারীশিক্ষা, সাহিত্য, সংগীত ও ধর্মচর্চায় কিছু নারীর অবদান থাকলেও, অন্যদিকে সমাজে পিতৃতান্ত্রিক শোষণ প্রবল ছিল। হিন্দু সমাজে কন্যাভ্রূণ হত্যা, বাল্যবিবাহ, সতীদাহের মতো প্রথা চালু ছিল। মুসলিম সমাজেও পর্দা প্রথা ও বহুবিবাহ চালু ছিল, যদিও কিছু পরিবারে নারীর মর্যাদা ছিল উঁচু।
তবে এই সময়েও কিছু অসামান্য নারী উঠে আসেন। মীরাবাঈ ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য নারী সাধিকা ছিলেন। রাজস্থানের রানী দুর্গাবতী, আহোম রাজ্যের রানী ফাকতুম্বা, এবং দক্ষিণের রাজমাতারা শাসনক্ষমতায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
নারীরা সংগীত ও নৃত্যকলায় অংশ নেন, বিশেষত মন্দির এবং রাজসভায়। কিছু নারী কবি ও লেখিকা নিজস্ব ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক দর্শন প্রকাশ করেন, যা পরবর্তী যুগের নারী আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে।
📌 পরবর্তী পর্বে পড়ুন: শিক্ষা, দর্শন, খাদ্যসংস্কৃতি ও সামগ্রিক মূল্যায়ন
লেবেল: মধ্যযুগ, ভারতের সংস্কৃতি, ইতিহাস, সংগীত, বিজ্ঞান, নারী, সুফি সংগীত, ভক্তি আন্দোলন, নৃত্য
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন