শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?
🔍 শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?
প্রেক্ষিত: খড়গ্রাম থানা, মুর্শিদাবাদ জেলা
পূর্বপ্রকাশিত: Edusmiths ব্লগ
🔰 ভূমিকা
ভাষা শুধুমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নয়—এটি একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পরিচয়। শেরশাহবাদিয়া ভাষা, যার মূল শিকড় বাংলার একটি ঐতিহাসিক পরগনায় গাঁথা, আজ বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব ও ভুল বানানের বলি। কেউ বলছে এটি “Sher Shah Abadi”, কেউ আবার বলছে এর উৎস আরবে! এই প্রবন্ধে আলোচ্য বিষয়ের ঐতিহাসিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও সমাজভাষাগত বিশ্লেষণ তুলে ধরা হবে।
🏛️ শব্দ উৎপত্তি ও নামের ব্যুৎপত্তি
“শেরশাহবাদিয়া” শব্দটি এসেছে “শেরশাবাদ পরগনা” থেকে। এটি ব্রিটিশ আমলে Sersabad বা Sarsabad নামে পরিচিত ছিল। এর স্থাননামভিত্তিক উৎপত্তি (Toponymic Origin) প্রমাণিত।
❌ “Sher Shah Abadi” – বিকৃত ও ভিত্তিহীন নাম
✅ “Shershabadia” – ইতিহাস ও প্রামাণ্য নথিতে গ্রহণযোগ্য নাম
🗺️ ভাষাগত অবস্থান ও ব্যাকরণ
এই ভাষা বাংলা ভাষারই একটি আঞ্চলিক রূপভেদ। এর ধ্বনি, বাক্যগঠন, ক্রিয়া ও বিভক্তি সম্পূর্ণ বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে, যদিও আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ধর্মীয় কারণে।
📚 শব্দভাণ্ডারের বৈশিষ্ট্য ও উদাহরণ
এই ভাষার নিজস্ব কিছু শব্দ আছে, যা অধিকাংশ বাংলা ভাষাভাষী জানেন না। নিচে কিছু শেরশাহবাদিয়া শব্দ ও অর্থ দেওয়া হলো:
শব্দ | বাংলা অর্থ |
---|---|
হামি | আমি |
হামারঘে | আমাদের বাড়ি |
অ্যাজ | আজ |
আচাক্কা | হঠাৎ |
কান্ধা | পাড়/কিনারা |
কবিতর | পায়রা |
কাউয়া | কাক |
কাঁঝিয়া | ঝগড়া |
খাম্বা | স্তম্ভ |
গহম | গম |
ঘিনাহা | নোংরা |
ঘ্যান | দুর্গন্ধ |
চ্যাংড়া | তরুণ/যুবক |
টামাটুল | টমেটো |
ডেরেন | নালা |
বাহু | বউ |
প্যাইট | শ্রমিক |
লদ্দি | নদী |
ল্যাগ্যা | জন্য |
ব্যারাম | অসুখ |
ভুঁটি | ভুঁড়ি |
হ্যাণ্ঠা | একগুঁয়ে |
শেরশাবাদিয়া ভাষা বাংলা ভাষারই একটি আঞ্চলিক রূপভেদ। তবে এই ভাষার শব্দভাণ্ডারে অনেক নিজস্ব শব্দ বিদ্যমান। এছাড়া পার্শ্ববর্তী বিহারী ভাষাসমূহের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। এই ভাষায় বহুল প্রচলিত কিছু শব্দ হলো:
হামি- আমি, হামার- আমার, হামরা- আমরা, হামারঘে- আমাদের, উ- সে, অর- তার, অরা- তারা, অরঘে- তাদের, তোরঘে- তোদের, তোমারঘে- তোমাদের।
অ্যাজ- আজ, অ্যাগনা- আঙিনা, অ্যাকখানটা- একট, ওসরা- উঠান, কপাট/দুয়ার- দরজা, আখা/চুল্হা- উনুন, আচাক্কা- হঠাৎ, আঞ্ঝাট্টা- আন্দাজে, ইন্দারা/কুহাঁ- কুয়া, কম্মর/মাঁজা- কোমর, কবিতর- পায়রা, কাউয়া- কাক, কাঞ্জুস- কৃপণ, কান্ধা/পাটাল- কিনারা/পাড়, কেহু- কেউ
কুণ্ঠে- কোথায়, কেনে/কী গোনে- কেন, ক্যাল- কাল, কোনাগুজরা- ঘরকুনো, কোর্যা- করে, ক্যাইচ্যা- কাস্তে, ক্যাউচা- কেঁচো, ক্যাজিয়া- ঝগড়া, ক্যাল্ল্যাই- কেন্নো, খাট্টা- টক, খাদ্দোল- গভীর, খাম্বা- স্তম্ভ, খিঁচ্চা/জালি- কচি, খোরা- বাটি, গোঢ়্যা- ডোবা, গোহিল- গোয়ালঘর, গড়ান- ঢাল, গতর- গা/দেহ, গহম- গম, গুদাম- বোতাম,
📌 আরও শতাধিক শব্দ রয়েছে যেগুলো শুধু শেরশাহবাদিয়া বলয়েই ব্যবহৃত হয় এবং এগুলোর উৎস বাংলা-ইসলামি লোকসংস্কৃতি।
🔍 পার্শ্ববর্তী ভাষার প্রভাব
বিহার সীমান্তবর্তী হওয়ায় কিছু ভোজপুরি/মগহি প্রভাব লক্ষ করা যায়, তবে তা গঠনে নয়, শুধু কিছু শব্দ ব্যবহারে।
🚫 বিভ্রান্তিকর তত্ত্বের খণ্ডন
- “Sher Shah Abadi” বানান ঐতিহাসিকভাবে অশুদ্ধ
- Nuristani বা আরব বংশতত্ত্ব ভিত্তিহীন ও ভ্রান্ত
- আরবি শব্দ ধর্মীয় ব্যবহারের কারণে, উৎস নয়
🔗 গবেষণা তথ্যসূত্র: Dr. Md. Abdul Wahab – IJCRT 2022 Paper
🗣️ ভাষার ভবিষ্যৎ ও সংরক্ষণের দাবি
এই ভাষা এখনো জীবিত থাকলেও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এর ব্যবহার কমছে। স্কুল, মিডিয়া, সাহিত্য ও প্রশাসনে এটি নেই বললেই চলে। অথচ এটি বাংলা ভাষার জীবন্ত উপভাষা – এর সংরক্ষণ ও স্বীকৃতি প্রয়োজন।
📚 তথ্যসূত্র
- Edusmiths পূর্বপ্রকাশিত পোস্ট
- Dr. Md. Abdul Wahab, IJCRT (2022)
- Assam University PhD Thesis (2015)
- Bengal District Gazetteers: Malda (Lambourn)
✍️ লিখেছেন: একজন গবেষণানুরাগী, খড়গ্রাম, মুর্শিদাবাদ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন