শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প
পশ্চিমবঙ্গের খড়গ্রাম ব্লকের এক কোণে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট গ্রাম শেরপুর, যেন সময়ের নীরব এক সাক্ষী। গ্রামটি বুক চিরে চলে গেছে এক ঐতিহাসিক পথ—বাদশাহী সড়ক, যা বর্তমানে পরিচিত ৭ নম্বর রাজ্য সড়ক নামে। এই রাস্তার দু’ধারে গড়ে উঠেছে শেরপুর গ্রামের জীবনধারা, ইতিহাস আর ঐতিহ্য।

শেরপুর নামের পিছনে লুকিয়ে আছে এক প্রাচীন কাহিনি। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে আফগান শাসক শেরশাহ তাঁর পুত্র জামালের সঙ্গে মিলিত হন এই অঞ্চলে। সেই থেকেই এই জায়গার নাম হয় শেরপুর—‘শেরশাহ’-এর নাম থেকে ‘শের’ শব্দটি নেওয়া হয়েছে। পাশের গ্রাম শাহপাড়ার নামও এসেছে ‘শাহ’ অংশটি থেকে। এই নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের রোমাঞ্চ ও রাজনীতির উত্তাপ।

মধ্যযুগে এই অঞ্চল ছিল খাল-বিল ও জঙ্গলে ঘেরা এক যুদ্ধক্ষেত্র। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে শেরপুরে এক বড় যুদ্ধ হয় মোঘল ও পাঠানদের মধ্যে। শেরপুর ছিল পাঠানদের ঘাঁটি, আর আতাই ছিল মোঘলদের দখলে। দুই শক্তির সংঘর্ষে রণভূমি হয়ে ওঠে এই গ্রাম ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা।
শেরপুরের ইতিহাসের সবচেয়ে দৃঢ় প্রমাণ হল শেরপুর জামে মসজিদ, যা মোঘল সম্রাট শাহজাহান-এর আমলে নির্মিত হয়। আজও মসজিদের ভিতরে ঢুকলে চোখে পড়ে সেই পুরনো স্থাপত্যের ছোঁয়া—ইটের কারুকাজ, দেয়ালের অলংকরণ যেন বলে চলে চারশো বছরের পুরনো কাহিনি।

সময় গড়িয়ে গেছে। ইতিহাস এখন স্মৃতিতে ঠাঁই করে নিয়েছে। তবু শেরপুর থেমে থাকেনি। বর্তমান শেরপুর প্রায় ৫০০ বর্গমিটার বিস্তৃত। গ্রামের মাঝ বরাবর চলে গেছে সেই ঐতিহাসিক রাজ্য সড়ক, যার দু’ধারে এখন গড়ে উঠেছে মুসলিম সমাধিক্ষেত্র। এই রাস্তা যেন অতীত ও বর্তমানকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে।
গ্রামে রয়েছে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত দুটি বিদ্যালয়—একটি প্রাথমিক এবং একটি উচ্চ মাধ্যমিক (এইচ.এস.) স্কুল। রয়েছে একটি বেসরকারি বি.এড কলেজ, যেখানে অনেক তরুণ-তরুণী শিক্ষকতার স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা করে। সপ্তাহে দু’দিন বসে হাট—আর এই হাট শুধু গ্রামের নয়, গোটা জেলার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে গবাদিপশুর হাট, যা জেলার অন্যতম বৃহৎ পশুর হাট হিসেবে পরিচিত।

শেরপুর শুধু ইতিহাস আর প্রতিষ্ঠান দিয়েই গর্বিত নয়, গর্বিত তার মানুষদের জন্যও। এই গ্রামে হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্ক বরাবরই সৌহার্দ্যপূর্ণ। মসজিদ আর মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ও আজানের ধ্বনি একসঙ্গে মিলে মিশে যেন বলে, “আমরা এক।”

বর্তমানে শেরপুরে জনসংখ্যা ৩৭৫৩ জন, যার মধ্যে পুরুষ ১৮৬৩ ও মহিলা ১৮৮৯ জন। শিশুদের সংখ্যা ৫১২ জন। গ্রামটির গড় স্বাক্ষরতার হার ৭১.৫৪%—এর মধ্যে পুরুষদের স্বাক্ষরতার হার ৭৫.৮৯% এবং মহিলাদের ৬৭.২৬%। এই সংখ্যাগুলি গ্রামটির অগ্রগতির গল্প বলে।
শেরপুর আজও বুকের ভেতর ধরে রেখেছে তার চারশো বছরের ইতিহাস, যুদ্ধের ধ্বনি, শাসকদের ছায়া, এবং সাধারণ মানুষের নিরবচেতা সংগ্রাম। আবার আজকের দিনে সে এগিয়ে চলেছে শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে ও সৌহার্দ্যে। অতীত আর বর্তমান মিলেমিশে যেন এক কথাই বলে—"শেরপুর শুধু একটি গ্রাম নয়, এটি ইতিহাসের পাতায় লেখা এক জীবন্ত অধ্যায়।"



তথ্য: মুর্শিদাবাদ জেলা গেজেটিয়ার ২০০৩, http://www.census2011.co.in/data/village/315111-serpur-west-bengal.html,

 *  মুর্শিদাবাদ জেলার মসজিদ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...