মধ্যযুগ বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ নয় – পর্ব ৪ | মুসলমানদের অবদান ও সেন শাসনের ভাষানীতির বিশ্লেষণ

মধ্যযুগ বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ নয় – পর্ব ৪

মুসলমানদের অবদান, সেনদের অবজ্ঞা ও বাংলা ভাষার নিচু তলার প্রাণশক্তি

বাংলা সাহিত্য ও ভাষার ইতিহাসে মধ্যযুগকে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা বহুদিনের অভ্যাস। তবে পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা দেখতে পেয়েছি, এই ধারণা একপাক্ষিক এবং অনেকাংশেই ভুল। এই পর্বে আমরা আলোচনার বিস্তার করব তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে—

  • ১. মধ্যযুগে মুসলমান শাসকদের ও সাধকদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদান
  • ২. সেন শাসকদের আমলে বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা ও অবদমন
  • ৩. সাধারণ হিন্দু সমাজে বাংলা ভাষার চল এবং উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গি

📜 মুসলমানদের অবদান: একটি বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ

১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি নদীয়া বিজয় করে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। এরপর প্রায় ৫০০ বছরের মুসলিম শাসন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। যদিও প্রশাসনিক ভাষা ছিল ফার্সি, তবু বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটেছিল মূলত মসনদ ও সাধক সমাজের সমান্তরাল প্রভাবের ফলে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম এখানে উঠে আসে—সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ। তিনিই প্রথম বাংলা কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। কবি মুকুন্দরাম, কবি কবিচন্দ্র, কবি আলাওল—এদের অনেকেই মুসলিম শাসকদের আনুকূল্য পেয়েছিলেন।

আলাওল (১৭শ শতক) আরাকানের মসনদে সাহিত্য রচনা করে বাংলা কাব্যের জগতে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। তাঁর অনুবাদিত গ্রন্থ ‘পদ্মাবতী’ মুসলিম রোমান্টিক ধারার এক অনন্য নিদর্শন। এছাড়া মীর মশাররফ হোসেন, সৈয়দ সুলতান, শেখ ফয়জুল্লাহ প্রমুখ সাধক ও কবি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

📛 সেন রাজবংশ ও বাংলা ভাষা: উপেক্ষা ও অবদমন

সেন রাজাদের আমলে (১১০০–১২৩০ খ্রি.) বাংলা ভাষা ছিল রাজদরবারের ভাষা নয়। সংস্কৃত ছিল প্রধান। ধর্মীয় কর্তৃত্ব, কুলীন প্রথা ও বর্ণভেদমূলক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে সেন রাজারা সংস্কৃত ও আর্যত্বকেই উচ্চতা দেন। বাংলা ভাষাকে তারা ‘অসাংস্কৃতিক’, ‘অভদ্র’ ও ‘শূদ্রভাষা’ মনে করতেন।

এই সময়কালেই দেখা যায়, উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে বাংলা ভাষা চর্চা লুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ে। মন্দিরে, ধর্মীয় সাহিত্য রচনায় বা শিক্ষায় বাংলা ভাষার কোনো স্থান ছিল না। বাংলা কাব্য ও গদ্যের প্রবাহ বহাল ছিল লোকমুখে, নিম্নশ্রেণির মানুষের কাছে।

🧓 নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রাণশক্তি

যেখানে রাজারা বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করতেন, সাধারণ কৃষক, তাঁতি, জেলে, শূদ্র, নমঃশূদ্রদের মুখে মুখে সেই ভাষা বেঁচে ছিল। লোককথা, পালা গান, বাউল সঙ্গীত, মঙ্গলকাব্য—এসবই উঠে এসেছে সেই সমাজের ভেতর থেকে।

মঙ্গলকাব্য যেমন চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল ইত্যাদি মূলত শূদ্র কবিদের রচনা। এরা না পেয়েছে রাজপৃষ্ঠপোষকতা, না শিক্ষিত সমাজের স্বীকৃতি, কিন্তু এদের রচনাই হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি।

বাংলা ভাষার স্বরূপ নির্মিত হয়েছে এই সাধারণ মানুষের মুখে। আর সেই কারণেই বাংলা ভাষা কখনো বিলুপ্ত হয়নি, বরং শত শত বছরের সামাজিক অবহেলাকে অতিক্রম করে টিকে গেছে।

📌 তথ্যসূত্র

  • ১. “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস”, ড. সুকুমার সেন
  • ২. “বাংলা ভাষার ইতিহাস”, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
  • ৩. “মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য”, অধ্যাপক মুহাম্মদ এনামুল হক
  • ৪. “History of Bengali Literature”, Dinesh Chandra Sen

📎 পূর্ববর্তী পর্বের লিংক

👉 আগামী পর্বে আমরা আলোচনা করব—"মধ্যযুগে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাহিত্য চর্চা ও তার তাৎপর্য"।

#বাংলাসাহিত্য #মধ্যযুগ #Edusmiths #BanglaHistory #মুসলিমশাসন #সেনরাজত্ব #BengaliLiterature

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...