মধ্যযুগ: বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ নয় (পর্ব-৪)
মধ্যযুগ: বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ নয় (পর্ব-৪)
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক – এই তিন পর্বে ভাগ করা হলেও, মধ্যযুগ নিয়ে একপ্রকার বিভ্রান্তি বা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বহুদিন ধরেই বিরাজমান। অনেকেই এই যুগকে ‘অন্ধকার যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সাহিত্য ও সমাজ বিশ্লেষণের নিরিখে মধ্যযুগ নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
💠 ধর্ম ও আধ্যাত্মবাদ: সাহিত্যিক প্রকাশ
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য একাধারে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতিফলন। বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য, শাক্ত পদাবলী – সবই এই সময়ের সৃষ্ট ধারা। ঈশ্বরের প্রতি প্রেম, মানবতাবোধ, সমাজসংস্কার – এই মূল্যবোধগুলিই সাহিত্যের মূল উপজীব্য।
বিশেষ করে চৈতন্যদেব এর ভক্তিবাদ ও শ্রীকৃষ্ণ-কেন্দ্রিক বৈষ্ণব সাহিত্য বাংলা ভাষাকে এক নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করেছিল। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস প্রমুখ কবিরা এই ধারার প্রধান প্রতিনিধি।
💠 সমাজ ও জাতিসত্তার গঠনে সাহিত্যের ভূমিকা
মধ্যযুগ ছিল বাংলার সামাজিক রূপান্তরের সময়। মুসলিম শাসন, হিন্দু পুনরুজ্জীবন, দরবেশ ও সাধু-সন্তদের প্রভাব – সব মিলিয়ে এই যুগে এক ধর্মীয় সহাবস্থান ও বহুত্ববাদী চিন্তার বিকাশ ঘটেছিল। সেই আবহেই গড়ে উঠেছিল সেক্যুলার সাহিত্য – যেমন ফকির-সন্ন্যাসী কাব্য, রূপকথা, পুঁথি সাহিত্যের ধারা।
এগুলো কেবল ধর্মের আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং গ্রামীণ জীবন, সমাজ-সংকট, নারীর অবস্থান, শ্রেণিচ্যুতি – এসব বিষয়কেও সাহিত্যের পরিসরে নিয়ে এসেছিল।
💠 ভাষার উন্নয়ন ও কাব্যরীতি
মধ্যযুগেই বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণগত কাঠামো গঠিত হয়। শব্দচয়ন, উপমা, অলংকারচর্চা, ছন্দরীতি – সবকিছু এক পরিণত রূপ লাভ করে। এই যুগেই বাংলার সাহিত্যে লোকভাষার স্বীকৃতি ঘটে।
চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল প্রভৃতি মঙ্গলকাব্যে প্রাচীন ও চলিত ভাষার চমৎকার সংমিশ্রণ দেখা যায়। কাব্যশৈলীতে কল্পনার বিশালতা ও চিত্রধর্মীতা তখনকার লেখকদের ভাবনাশক্তির প্রমাণ দেয়।
💠 নারী, প্রকৃতি ও জীবনঘনিষ্ঠতা
এই যুগের সাহিত্যে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। মঙ্গলকাব্যের দেবী চরিত্র, বৈষ্ণব সাহিত্যের রাধা বা পুঁথি সাহিত্যের সুলতানার গল্প – সবকিছুতেই নারীর এক শক্তিশালী ও স্বাধীন চিত্রায়ণ লক্ষণীয়।
প্রকৃতি ও জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককেও সাহিত্যে তুলে ধরা হয়েছে। নদী, গ্রাম, কৃষিজীবন – এইসব চিত্র সাহিত্যের মধ্য দিয়ে বাস্তবতাকে রূপকথার মতো করে তুলেছিল।
💠 উপসংহার
অতএব, মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ বলা সাহিত্যচর্চার প্রতি অবিচার। এটি একদিকে বাংলা ভাষার ভিত্তি মজবুত করেছে, অন্যদিকে সমাজচেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছে। এই যুগের সাহিত্য মানবিকতা, সহনশীলতা ও আত্মিক পরিশুদ্ধির এক অনন্য দলিল।
📚 তথ্যসূত্র
- বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত – সুকুমার সেন
- বাংলা সাহিত্য পরিচয় – ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
- মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য – ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য
- জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলা সাহিত্য পাঠক্রম (উচ্চ মাধ্যমিক)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন