সপ্তম শ্রেণি,ইতিহাস, চতুর্থ শ্রেণির সুলতানী শাসন এর পাঁচ নম্বরের প্রশ্নোত্তর পাঁচটা
সপ্তম শ্রেণি | ইতিহাস | চতুর্থ অধ্যায়: সুলতানী শাসন
📚 পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ ৫ নম্বরের প্রশ্নোত্তর
---
❓ ১. ইলতুৎমিসের প্রথম তিনটি সমস্যা কী ছিল? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর :-ইলতুৎমিস ছিলেন দিল্লির প্রথম প্রকৃত সুলতান যিনি সুলতানী শাসনের ভিত শক্ত করে তুলেছিলেন। তবে সিংহাসনে বসার পর তাঁকে একাধিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রধান তিনটি সমস্যার বর্ণনা নিচে দেওয়া হল—
---
১) রাজতান্ত্রিক বৈধতা নিয়ে সমস্যা:
ইলতুৎমিস কুতুবউদ্দিন আইবকের জামাতা এবং নিজে ছিলেন একজন দাস। তাই সুলতান হিসাবে তাঁর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়। তুর্কি আমির ও অভিজাতেরা তাঁকে সুলতান হিসাবে মানতে চায়নি। এই কারণে তাঁর শাসন শুরুতেই নানান রাজনৈতিক চক্রান্ত ও বিদ্রোহের শিকার হয়। বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি পরবর্তীতে আব্বাসি খলিফার স্বীকৃতি আদায় করেন।
---
২) প্রাদেশিক শাসকদের বিদ্রোহ:
তৎকালীন ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে আলাদা আলাদা গভর্নর বা শাসক ছিলেন, যারা কুতুবউদ্দিন আইবকের মৃত্যুর পর নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে ফেলেছিল। ইলতুৎমিস যখন সুলতান হন, তখন অনেক প্রাদেশিক শাসক দিল্লির কর্তৃত্ব মানতে রাজি ছিলেন না। ফলে তাঁকে একাধিক সামরিক অভিযান চালিয়ে পুনরায় এসব এলাকা দিল্লির অধীনে আনতে হয়—যেমন, বাঙ্গাল, বিহার, রাজস্থান, পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চল।
---
৩) বাহ্যিক আক্রমণের আশঙ্কা:
তখনকার সময় ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল ছিল অস্থির ও ঝুঁকিপূর্ণ। আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার খোয়ারিজ রাজবংশের শাসকরা ভারতের দিকে আগ্রাসী মনোভাব দেখাতে থাকে। এদের আক্রমণ প্রতিহত করতে এবং সীমান্ত রক্ষা করতে ইলতুৎমিসকে কৌশলী ও শক্ত হাতে সেনা অভিযান পরিচালনা করতে হয়।
---
📌 উপসংহার:
এই তিনটি বড় সমস্যার সফলভাবে মোকাবিলা করে ইলতুৎমিস শুধু নিজের অবস্থানই দৃঢ় করেননি, বরং একটি সুসংগঠিত সুলতানী প্রশাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন। এই কারণে তাঁকেই প্রকৃতপক্ষে দিল্লির প্রথম কার্যকর সুলতান বলা হয়।
---
❓ ২. ইলতুৎমিস দিল্লির সুলতানী শাসনের ভিত কিভাবে মজবুত করেছিলেন? বিশ্লেষণ করো।
✅ উত্তর:
ইলতুৎমিস ছিলেন সুলতানী শাসনের এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিপ্রস্তর। তিনি দিল্লির সুলতান হিসাবে কেবল ক্ষমতা গ্রহণই করেননি, বরং শাসন কাঠামোকে সুসংগঠিত করে তুলেছিলেন। তাঁর প্রধান কার্যকলাপগুলি নিচে আলোচনা করা হলো:
---
১) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্থাপন:
তিনি বিভিন্ন বিদ্রোহী ও পৃথক হয়ে যাওয়া প্রদেশগুলিকে পুনরায় দিল্লির নিয়ন্ত্রণে আনেন। যেমন—বিহার, বাংলার কিছু অঞ্চল, রাজস্থান প্রভৃতি। এতে কেন্দ্রীয় শাসনের ভিত মজবুত হয়।
---
২) চাহালগানি গঠন:
ইলতুৎমিস ৪০ জন বাছাই করা তুর্কি আমিরদের নিয়ে 'চাহালগানি' নামে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। এটি প্রশাসন পরিচালনায় তাঁকে সাহায্য করত।
---
৩) আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন:
তিনি আব্বাসি খলিফার কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায় করেন। এর ফলে মুসলিম বিশ্বের কাছে দিল্লির সুলতানী শাসনের একটি বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
---
৪) অর্থনীতি ও মুদ্রা সংস্কার:
তিনি ‘টঙ্কা’ (রুপোর মুদ্রা) এবং ‘জিত্তাল’ (তামার মুদ্রা) চালু করেন, যা দিল্লি সুলতানীর আর্থিক ব্যবস্থা সুসংগঠিত করে তোলে।
---
📌 উপসংহার:
এইসব পদক্ষেপ ইলতুৎমিসকে শুধু সফল সুলতান নয়, বরং সুলতানী শাসনের প্রথম প্রকৃত স্থপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
---
❓ ৩. রজিয়া সুলতানা কে ছিলেন? তিনি ব্যতিক্রমী শাসক কেন ছিলেন? ব্যাখ্যা করো।
✅ উত্তর:
রজিয়া সুলতানা ছিলেন ভারতের ইতিহাসে প্রথম এবং একমাত্র মুসলিম নারী সুলতান। তিনি ছিলেন ইলতুৎমিসের কন্যা এবং অত্যন্ত বিদুষী, সাহসী ও দক্ষ শাসক।
---
১) নারী হয়েও সুলতান হওয়া:
তৎকালীন সময় ছিল পুরুষশাসিত সমাজ। সেখানে একজন নারী হয়ে তিনি সিংহাসনে বসেছিলেন। এটি ছিল একেবারেই অস্বাভাবিক এবং সাহসী পদক্ষেপ।
---
২) প্রশাসনিক দক্ষতা:
তিনি সরাসরি প্রশাসন পরিচালনা করতেন, রাজদরবারে পুরুষদের মতো পোশাক পরতেন এবং নিজ হাতে রাজ্যের কাজ তদারকি করতেন।
---
৩) বিদ্রোহ ও সংগ্রাম:
চাহালগানির কিছু তুর্কি অভিজাত তার নারী পরিচয়ের কারণে শাসন মানতে চাননি। রজিয়া তাদের বিদ্রোহ দমন করার চেষ্টা করেন।
তবে পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের কারণে তাকে সিংহাসনচ্যুত করা হয় এবং নিহতও হন।
---
📌 উপসংহার:
নারী হয়েও এক পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তিনি সুলতান হিসাবে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এজন্য রজিয়া সুলতানা ছিলেন একজন অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ও সাহসী শাসক।
---
❓ ৪. বলবনের ‘নিয়ম ও শৃঙ্খলা’ নীতির গুরুত্ব ব্যাখ্যা করো।
✅ উত্তর:
বলবন ছিলেন সুলতানী শাসনের এক কঠোর কিন্তু দক্ষ শাসক। তিনি রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য ‘নিয়ম ও শৃঙ্খলা’ নীতি অনুসরণ করেন, যা তার শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
---
১) চাহালগানির শক্তি হ্রাস:
তিনি অভিজাতদের সমিতি চাহালগানিকে ধ্বংস করে রাজতন্ত্রের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেন। এইভাবে প্রশাসন দুর্বলদের হাতে পড়া থেকে রক্ষা পায়।
---
২) দরবারে শৃঙ্খলা ও নিয়ম:
বলবন দরবারে কঠোর প্রটোকল চালু করেন। সুলতানের সামনে কারো কথা বলার নিয়ম ছিল না। "জমলাহ" এবং "সিজদাহ" প্রথা চালু করে সুলতানের মর্যাদা বাড়ান।
---
৩) আইনের শাসন:
রাজ্যে অপরাধ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি চালু করেন। বিচারব্যবস্থায় কঠোরতা এনে জনগণের মধ্যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন।
---
📌 উপসংহার:
বলবনের ‘নিয়ম ও শৃঙ্খলা’ নীতি দিল্লির সুলতানী শাসনের স্থিতিশীলতা ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করে তোলে।
---
❓ ৫. চাহালগানি কী? চাহালগানির প্রভাব আলোচনা করো।
✅ উত্তর:
চাহালগানি ছিল ইলতুৎমিস গঠিত ৪০ জন অভিজাত তুর্কি আমিরদের নিয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা পরিষদ। এটি মূলত সুলতানের প্রশাসনিক ও সামরিক কাজে সহায়তা করার জন্য তৈরি হয়েছিল।
---
১) প্রাথমিক ইতিবাচক ভূমিকা:
শুরুর দিকে চাহালগানি প্রশাসনের স্থিতি ও নীতি-নির্ধারণে সহায়ক হয়। তারা সুলতানের পাশে থেকে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করত।
---
২) স্বেচ্ছাচারিতা ও ষড়যন্ত্র:
ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর চাহালগানির সদস্যরা ক্ষমতার লোভে নিজেরা রাজ্য পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে থাকে। তারা একাধিক সুলতানকে হত্যা বা পদচ্যুত করে।
---
৩) রজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধাচরণ:
চাহালগানি রজিয়া সুলতানাকে নারী বলে সিংহাসনে মানতে রাজি হয়নি এবং তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।
---
📌 উপসংহার:
চাহালগানি একদিকে শাসনব্যবস্থায় সাহায্য করলেও পরে তারা রাজনৈতিক স্বার্থে সুলতানী শাসনের ভিত দুর্বল করে তোলে। তাই বলবন তাদের দমন করে দিল্লি শাসনের স্থিতি ফেরান।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন