মধ্যযুগ বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ নয়: কলঙ্কের আবরণে আড়াল হওয়া এক সুবর্ণ অধ্যায় (শেষ পর্ব)"

🔍 প্রস্তাবনা

‘মধ্যযুগ’ শব্দটি বাংলা সাহিত্যে উচ্চারিত হলেই তার সঙ্গে লেগে থাকে একধরনের অদৃশ্য অবজ্ঞা—এটা যেন কেবল ধর্মীয় কাব্য, দাসত্বে পরিণত ভাষা, এবং অন্ধকারে ডুবে থাকা সময়ের প্রতিনিধি। অথচ বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। আজকের আধুনিক বাংলা ভাষার ভিত যে জমিতে গড়ে উঠেছে, তা মূলত প্রান্তিক জনগণের মুখের ভাষা, মুসলমান কবিদের সরল অথচ দার্শনিক ভাবনার গীত, এবং জনগণের হৃদয়ে গাঁথা কথাসাহিত্য। এই সত্যকে বারবার উপেক্ষা করা হয়েছে তথাকথিত ‘অন্ধকার যুগ’ তত্ত্বে।

📌 মুসলমানদের অবদান – বিস্মৃত ইতিহাস

বাংলা সাহিত্যর জন্ম ও বিবর্তনে মুসলমান কবিদের অবদান বহুদিন অবহেলিত থেকেছে। শেখ ফয়জুল্লাহ, সৈয়দ সুলতান, আফজল আলি, আবদুল হাকিম প্রমুখ কবিরা শুধু ধর্মকথা লেখেননি, তারা সমকালীন সমাজ, নৈতিকতা, ইতিহাস ও মানবিক চেতনার কথা বলেছিলেন।

  • সৈয়দ সুলতান: চৈতন্যচরিত, নবীবংশের গীত এবং দর্শনচর্চা—তার লেখায় ইসলাম ও হিন্দু ঐতিহ্য মিলেমিশে গেছে।
  • আবদুল হাকিম: তাঁর বিখ্যাত উক্তি—“যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি”—আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।

এঁরা প্রমাণ করেছেন, ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে সাহিত্যে সত্য, ন্যায় এবং মাতৃভাষার মর্যাদাই মুখ্য। অথচ দীর্ঘদিন বাংলা পাণ্ডিত্যচর্চা এই কবিদেরকে "সেকেন্ডারি" মান্যতা দিয়েছে।

🏛️ সেন ও পাল বংশের বাংলা ভাষাবিরোধী নীতি

পাল রাজাদের সময়েও সংস্কৃত ছিল প্রধান সাহিত্য ও প্রশাসনিক ভাষা। কিন্তু তুলনামূলকভাবে তারা অনেক উদার ছিলেন। সেন বংশের সময়ে এই উদারতা হ্রাস পায়। বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেন প্রমুখ রাজারা বাংলা ভাষাকে সাধারণের ভাষা বলে অবজ্ঞা করেন। ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জোর করে চাপিয়ে দেন। ফলত, সাধারণ হিন্দু সমাজের উচ্চশ্রেণির মধ্যে বাংলা লেখালেখি নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে।

🧑‍🌾 প্রান্তিক হিন্দুদের মুখে বাংলা, কিন্তু পাণ্ডিত্যে নয়

অবজ্ঞিত হলেও বাংলা ভাষা টিকে ছিল সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মৃৎশিল্পী, তাঁতিদের মুখে মুখে। মৌখিক সংস্কৃতি হিসেবে নানা পালা, লোকগান, শাক্ত পদ, বৈষ্ণব গান বাংলার হৃদয়ে বাসা বাঁধে। কিন্তু পাণ্ডিত্য সমাজ তা সাহিত্যরূপে গ্রহণ করেনি। ফলে এক শ্রেণির ভাষা হয়ে পড়ে ‘সাহিত্যিক’, আর এক শ্রেণির ভাষা হয়ে পড়ে ‘অসাহিত্যিক’। এই ভেদাভেদ আধুনিক বাংলারও অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে।

🌱 ভাষার বিবর্তন এবং মুসলমানদের ভূমিকা

মুসলমান কবিরা বাংলায় ধর্মচর্চা করতে গিয়ে ভাষাকে সরল, সঙ্গীতময়, মানবিক করে তুলেছেন। আরবি-ফারসি শব্দ বাংলায় যুক্ত হলেও তার কাঠামো বাংলাই থেকে গেছে। মুসলমান শাসকেরাও আরবি-ফারসি নয়, গ্রামাঞ্চলে বাংলাকেই গ্রহণ করেন শাসনকাজে। পীর-দরবেশেরা বাউল ধারায় মিশে গিয়ে বাংলায় আধ্যাত্মিক জীবনদর্শন দিয়েছেন। এই বহুমুখী অবদানের ফলেই বাংলা ভাষা টিকেছে এবং সমৃদ্ধ হয়েছে।

📉 কেন একে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হলো?

একটি বড়ো কারণ হল ঔপনিবেশিক সময়কালে ইউরোপীয় দর্শন ও পণ্ডিতচক্রের মাধ্যমে বাংলার সাহিত্য ইতিহাস রচিত হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন থেকে শুরু করে দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেকেই প্রারম্ভিক সময়ে মধ্যযুগকে ‘পথহারা ধর্মান্ধতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসের একটি মাত্র দিক দেখে সিদ্ধান্ত।

তথ্যসূত্র ঘাঁটলে দেখা যায়:

  • মোহিতলাল মজুমদার (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত)
  • সুকুমার সেন (বাংলা ভাষার ইতিহাস)
  • অশোক মিত্র (বাংলা সাহিত্যের রূপান্তর)
  • আনিসুজ্জামান (মুসলমান সমাজ ও বাংলা সাহিত্য)
  • প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও আবিষ্কৃত হয়েছে মসজিদের দেওয়ালে বাংলা শ্লোক

🔍 আজকের প্রেক্ষাপটে পুনর্বিবেচনা জরুরি

আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের উচিত সাহিত্যের ইতিহাস নতুন করে দেখা। প্রান্তিক, সংখ্যালঘু, কৃষক, নারী, শ্রমজীবী মানুষের মুখে যে সাহিত্য জন্ম নেয়, তাকে ‘কম মূল্যবান’ বলার দিন ফুরিয়ে গেছে। বাংলা ভাষার প্রাণ তার প্রান্তিকতায়, তার ধ্বনিতে, এবং জনমানুষের অন্তরে।

✅ উপসংহার

মধ্যযুগ বাংলার জন্য এক মহান জনভাষার আত্মপ্রকাশের সময়কাল। এটি ধর্মীয় কাব্য দিয়ে শুরু হলেও, ক্রমে একটি সমাজের আত্মপরিচয়ের ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। এই যুগে মুসলমান কবি ও প্রান্তিক মানুষের অবদান না থাকলে আজকের বাংলা ভাষা এত সমৃদ্ধ হতো না।

তাই ‘মধ্যযুগ অন্ধকার’ নয়—এটি এক লুকোনো দীপ্তির সময়, যা পুনরুদ্ধার করতে হবে সাহস, গবেষণা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...