"মধ্যযুগ বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ নয় – প্রান্তিক ও মুসলিম সমাজের অবদান" পর্ব -৫

মধ্যযুগ বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ নয় – প্রান্তিক ও মুসলিম সমাজের অবদান

ভূমিকা:
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে “মধ্যযুগ” শব্দটি যেন একটি বিভাজক রেখা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একপক্ষ একে সোনালি যুগ বলে অভিহিত করলেও অন্যপক্ষ একে ‘অন্ধকার যুগ’ বলে নিন্দিত করেছে। প্রশ্ন হলো—এই ‘অন্ধকার’ কার জন্য? কারা ছিল সেই যুগের আলোর বাহক? ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, যাঁরা ‘অন্ধকার’ বলছেন, তাঁরা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারাকে শুধু উচ্চবর্গীয় সংস্কৃত নির্ভর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন। বাস্তবে এই যুগেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং বাংলার মুসলিম সমাজ বাংলা ভাষাকে গ্রামীণ স্তর থেকে সাহিত্যিক স্তরে তুলে এনেছেন।

১। সেন রাজবংশ ও বাংলাভাষার উপর অবদমন

বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক ছিল পাল ও সেন যুগ। পালরা যদিও বৌদ্ধ ছিলেন এবং তুলনামূলকভাবে উদারচেতা, সেনরা ছিলেন কট্টর হিন্দু। সেন রাজাদের মধ্যে বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেন বিশেষভাবে খ্যাত। বল্লাল সেন ‘বর্ণাশ্রম ধর্ম’ ও জাতপাত ব্যবস্থাকে কঠোরভাবে চালু করেন। এর ফলে বাংলাভাষার উপর চেপে বসে সংস্কৃত ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য। উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ সমাজ ও রাজসভার সাহিত্যচর্চা হয়ে পড়ে সংস্কৃতকেন্দ্রিক।

এই সময় বাংলাভাষাকে দেখা হতো ‘অশুদ্ধ’, ‘চণ্ডাল ভাষা’ হিসেবে। রাজসভার কবিরা সংস্কৃত চর্চা করতেন এবং বাংলা ভাষায় লেখাকে হীন ও নিচু শ্রেণির কাজ বলে গণ্য করতেন। ফলে, বাংলাভাষার বিকাশ মূলত গৃহবন্দি হয়ে পড়ে নিম্নশ্রেণির, সাধারণ জনগণের মুখে মুখে।

২। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখে বাংলার বেঁচে থাকা

বাংলাভাষা যে আদিতে সাধারণ মানুষের ভাষা, তা ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে। উচ্চশ্রেণির অবজ্ঞা সত্ত্বেও বাংলার গ্রামীণ মানুষ—চাষি, মজুর, পাল, কামার, কুমোর, তাঁতি, জেলে প্রভৃতি শ্রেণির মানুষের মুখে বাংলাভাষা টিকে ছিল। তাঁরা এই ভাষায় গান গেয়েছেন, লোককথা শুনিয়েছেন, প্রেম-দুঃখ-ভক্তি-রাগ সবকিছু প্রকাশ করেছেন।

সেনদের দমননীতির ফলে হয়তো উচ্চপর্যায়ের সাহিত্যচর্চা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু এই প্রান্তিক সমাজই বাংলা ভাষার প্রাণ ধরে রেখেছিল। আজ আমরা যেসব লোকসাহিত্য, পালাগান, বাউলগীতি, ব্রতকথা পাই, তার মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছে এই স্তরে।

৩। মুসলমান শাসকদের ভূমিকা ও ভাষার প্রতি উদারতা

১২০১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে। ধর্মগতভাবে তাঁরা আরবি-ফারসি প্রভাবিত হলেও বাংলাভাষার প্রতি ছিল তাদের এক ধরনের প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক উদারতা। মুসলিম শাসকেরা গ্রাম ও জনপদে বাংলা ব্যবহারে কোনো বাধা দেননি। বরং আঞ্চলিক ভাষায় মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে বাংলাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ফলে প্রশাসনিক ঘোষণাগুলো বা ইসলাম প্রচারের ভাষা হিসেবে বাংলার ব্যবহার শুরু হয়।

আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বাংলার মুসলিম কবিরা এই বাংলাভাষাতেই সাহিত্য রচনা শুরু করেন। তাঁরা সাহিত্যের মূল বিষয় করেন ঈশ্বরপ্রেম, মানবপ্রেম ও নৈতিকতা। এই ধারাকে বলা হয় ‘নব্য বৈষ্ণব’ প্রভাবিত বাংলা মুসলিম সাহিত্যধারা।

৪। মুসলিম কবিদের অবদান: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

  • শেখ ফখরুদ্দীন: তাঁর লেখা “শাহর নাইমা” বাংলার প্রথম মুসলিম ইতিহাসভিত্তিক কবিতা।
  • সৈয়দ সুলতান: ১৬শ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম কবি। তাঁর রচিত “নবী বংশ” ও “রসুল বিজয়” বাংলাভাষায় ইসলামী ভাবানুগ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
  • আলাওল: আরাকানের রাজসভায় কর্মরত এই কবি মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। তাঁর অনুবাদ করা ফারসি মহাকাব্য ‘পদ্মাবতী’ আজও বাংলা সাহিত্যসুধার একটি রত্ন।
  • দৌলত কাজী: ‘সতীময়না-লোরচন্দ্রানি’ রচয়িতা দৌলত কাজী বাংলা রোম্যান্টিক কাব্যধারার এক অগ্রগামী।

৫। বাংলা ভাষার বিস্তার ও মুসলিমদের অবদান

প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্য ভাষা ছিল সংস্কৃত, মধ্যযুগে ছিল ফারসি—বাংলা সেই দুই ভাষার ছায়ায় বেড়ে উঠেছে। মুসলিম দরবেশ, সুফি সাধকরা বাংলাকে জনমানুষের ভাষা করে তুলেছেন। তাঁরা আরবি-ফারসি শব্দের সঙ্গে বাংলার মিশ্রণ ঘটিয়ে এক নতুন ধারা তৈরি করেন—যা পরবর্তীতে বাংলা গদ্যের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

শুধু কাব্যসাহিত্যই নয়—মুসলিম লেখকরা ইতিহাস, ব্যাকরণ, অনুবাদ সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থ রচনাতেও বাংলাকে ব্যবহার করেন। এক উদাহরণ—মার্কিন অধ্যাপক ডেভিড কুরজম্যান তাঁর বই “Early Bengali Literature in Muslim Period” এ বলেন: “It was the Bengali Muslim poets who introduced narrative poetry in vernacular Bengali long before modern Bengali prose developed.”

৬। আজও কেন কলঙ্কের তকমা?

এতসব অবদান সত্ত্বেও কেন আজও বলা হয়—“মধ্যযুগ ছিল বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ”? এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে ব্রাহ্মণ্য চেতনায় অনুপ্রবেশকারী আধুনিক ঐতিহাসিক বর্ণনায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চবর্ণীয় হিন্দু, যাঁরা মুসলিম সাহিত্যিক ও লোকায়ত ধারার সাহিত্যকে ‘অশুদ্ধ’ ও ‘অমার্জিত’ বলে খারিজ করে দিয়েছেন।

এছাড়া, পশ্চিমা ধারণায় “Dark Age” মানে মধ্যযুগীয় ধর্মভিত্তিক সাহিত্য, যেখানে মানবজীবনের যুক্তি বা বুদ্ধির প্রকাশ কম। কিন্তু বাংলার ‘ধর্ম’তত্ত্বেও রয়েছে মানবিকতা, প্রেম ও বিদ্রোহ। তাই পশ্চিমা ‘Dark Age’ ধারণা সরাসরি বাংলা সাহিত্যে প্রয়োগ করা একরকম বুদ্ধিবিভ্রান্তি।

৭। মুক্তির পথ: তথ্য ও যুক্তির আলোয় ইতিহাস বিশ্লেষণ

বাংলা ভাষার আসল ইতিহাস খুঁজতে হলে নিচু তলার মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ানো সেই ভাষার পথরেখা ধরতে হবে। মঙ্গলকাব্য, পুঁথি সাহিত্য, চৌতালগান, কবির লড়াই—এইসব লোকজ ধারার উৎস খুঁজে নিতে হবে। সেই ইতিহাসে প্রান্তিক মানুষ, নারীরা, মুসলমানরা, অনগ্রসর শ্রেণি ছিলেন ভাষার প্রকৃত বাহক।

বাংলা ভাষার বিকাশ কখনোই শুধুমাত্র রাজসভার সংস্কৃত ঘরানার সাহিত্যিকদের অবদানে হয়নি। বরং গ্রামীণ বাংলার দরিদ্র চাষি-মজুর, সুফি-দরবেশ, বাউল, মুসলিম কবি, সমাজচ্যুত প্রেমিক-কবি ও সাধকদের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের বৈচিত্র্য ও শক্তি।

উপসংহার

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ মানেই অন্ধকার—এই ধারণা আসলে একপাক্ষিক ইতিহাসচর্চার ফল। প্রান্তিক জনগণ ও মুসলিম সমাজের অনবদ্য অবদান, সাহসী সাহিত্যচর্চা, এবং বাংলাভাষার গঠন ও রক্ষার পেছনে তাঁদের নিরলস সংগ্রামকে উপেক্ষা করে কখনোই এই ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না। আজ প্রয়োজন সেই ইতিহাসকে পুনঃলিখন করার, যেখানে কোনো শ্রেণি বা ধর্ম নয়—মানুষই হবে ভাষার কেন্দ্রবিন্দু।


📚 তথ্যসূত্র:

  • ড. সুকুমার সেন, “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস”
  • আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, “মুসলমানদের বাংলা সাহিত্য”
  • ডেভিড কুরজম্যান, “Early Bengali Literature in Muslim Period”
  • শিক্ষা ও গবেষণা সাময়িকী: “বাংলা সাহিত্যে সুফি-দরবেশদের প্রভাব”

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...