ইচ্ছা গল্প পর্ব -১২
গল্প: ইচ্ছা (পর্ব – ১২) (ছায়া ঘনায় আরও)
কলকাতার সেই ব্যস্ত ঘিঞ্জি অলিগলির মধ্যে নিজের নতুন ঠিকানা গড়ে নিয়েছিল আদর। পুরনো সব সম্পর্ক থেকে দূরে, চেনা মুখগুলোর থেকে দূরে। এখানে সে একজন হোম ডেলিভারি বয়ের কাজ নেয়। মাসে যা রোজগার, তাতে বাড়িতে টাকা পাঠানো যায়, কিন্তু নিজেকে ঠিক বাঁচিয়ে রাখা যায় না।
শুরুর দিকে সে বোনের মেয়েটির খরচ চালাত, মায়ের জন্য সামান্য কিছু পাঠাত, হিয়া-কেও পাঠাত, যদিও ফোনে কথা হত না বিশেষ। কিন্তু এই টানাপোড়েনের মাঝে সে আরও একবার জড়িয়ে পড়ল পুরনো সেই নেশায়—এবার আরও গভীরে।
আদরের দিন শুরু হত রাস্তার ধারে চা-সিগারেট দিয়ে, আর রাত শেষ হত বন্ধু নামের কিছু ছেলেদের সঙ্গে 'ড্রাফ্ট' আর 'ট্যাবলেট'-এ।
একজন বন্ধু, নাম তুহিন, তাকে বলেছিল, “ভাই, তোকে দেখে মনে হয় না তুই বাঁচতে চাস। কিসের এত চিন্তা? মা, বউ, মেয়ে—তারা তোকে ভালবাসে? নাকি তুই শুধু দায়িত্ব পালন করিস?”
আদর হাসত, বলত, “আমি মানুষ না, শুধু এক টাকাওয়ালা এটিএম।”
এই হাসির পিছনে লুকিয়ে ছিল অজস্র অভিমান, গ্লানি, ক্লান্তি।
গ্রামে meanwhile...
ইচ্ছা হাঁফিয়ে উঠেছেন। ছেলের খোঁজ নেই, ফোন বন্ধ, টাকা আসেও না মাঝে মাঝে। হিয়া চুপচাপ, সংসারের কাজ করে। বাচ্চা নেই বলে সবাই তার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। কেউ বলে, “হিয়া বউটি অভিশপ্ত।” কেউ বলে, “আদরেরই দোষ, নেশা ছেড়ে দিলে এসব হত না।”
একদিন গ্রামের রাস্তায় দুই মহিলার কথোপকথন শুনে ইচ্ছার চোখে জল আসে—
—“ওই যে আদর, এখন নাকি কলকাতার কোথায় যেন এক থার্ডক্লাস মেয়ের সাথেই থাকে।”
—“হিয়া বউটিরও তো কোনো দোষ নেই গো!”
ইচ্ছা কিছু বলে না, শুধু দুচোখ মুছে নেয়।
আদরের ভেতরে একটা দ্বিধা দানা বাঁধে—সে হিয়া-কে ভুল বোঝে, আবার ভালোবাসেও। কিন্তু নিজের গ্লানির ভারে কাউকে মুখ দেখাতে পারে না। বোনের মেয়েটির প্রতি মায়া কাজ করে, সেই একটা দিকেই যেন তার ভেতরের মানুষটা এখনও বেঁচে আছে।
একদিন রাতে, সে ফোন করে হিয়াকে। হিয়া শুধু বলে, “আসিস না যদি আসতে না মন চায়, কিন্তু ভুলেও মিথ্যে কথা বলিস না।”
আদর বলে, “আমি আসব... কিছুদিনের মধ্যে।”
তবে এবার সে ফিরল অন্যরকম হয়ে। চুল-দাড়ি অগোছালো, চোখ লাল, দেহ ভেঙে গেছে। মা তাকে দেখে বুঝলেন কিছু একটা ভয়ঙ্কর ভুলের মধ্যে সে ডুবে আছে। হিয়া তাকে দেখে হাসে, কিন্তু চোখে কষ্টের কালি জমে।
সে বোনের মেয়েটিকে আদর করে, কিন্তু চাইলেও নিজেকে দূরে রাখতে পারে না সিগারেটের ধোঁয়া থেকে। পাড়ার এক উৎসবে তাকে নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়, “আদরের চরিত্র তো কদিন আগেই ভেসে উঠেছে, এখন আবার ছুটে এসেছে নাটক করতে।”
বাড়ির ভেতরেও সেই চাপ টের পাওয়া যায়। মা ইচ্ছা খাটে বসে থাকে, মুখে কিছু বলে না, কিন্তু চোখের চাহনিতে অনেক প্রশ্ন।
একদিন হিয়া তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই ঠিক আছিস তো? চোখে চোখ রাখবি?”
আদর চুপ থাকে।
রাতে সে নেশার ঘোরে ঘরের সামনে বসে থাকে একা। এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে ফোন। সে একটা ছোট ভিডিও দেখে—বোনের মেয়েটা হাসছে। তার মুখে তখন কাঁটা বিঁধে যায়—এই মেয়েটার জন্যই সে বাঁচতে চেয়েছিল, আজ নিজেই ধ্বংসের মুখে।
পর্ব শেষ হয় আদরের এক নির্জন চিন্তায়:
“আমি কী আদৌ মানুষ ছিলাম? নাকি শুধু মায়ের স্বপ্নের ধ্বংসাবশেষ?”
(চলবে – পরবর্তী পর্বে চূড়ান্ত পরিণতি)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন