ইজরায়েল রাষ্ট্রের উৎপত্তি? ইজরাইল রাষ্ট্রের গঠনে বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তির ভূমিকা? ইজরাইলকে আমেরিকার জারজ সন্তান বলা হয় কেন? ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিনকেইা বেছে নেওয়া হয়েছিল কেন? আব্রাহামীর ধর্মে জেরুজালেম শহরের গুরুত্ব?
---
🟦 ইজরায়েল রাষ্ট্রের উৎপত্তি: এক ঐতিহাসিক পটভূমি
🔹 ১. প্রাচীন পটভূমি:
ইহুদি জাতির প্রাচীন ইতিহাস মিশর থেকে ক্যানান দেশে (বর্তমান ফিলিস্তিন ও ইজরায়েলের অংশ) আগমন দিয়ে শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে রাজা দাউদ ও সলোমনের অধীনে ইসরায়েল-জুডাহ নামে দুটি রাজ্যের সৃষ্টি হয়। তবে রোমান শাসনামলে (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় ৭০ অব্দ পর্যন্ত), বিশেষত ৭০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ইহুদি মন্দির ধ্বংস এবং বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর ইহুদিরা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে—এটি “ডায়াসপোরা” নামে পরিচিত।
---
🟦 ইহুদিদের বিতাড়ন: কোন কোন দেশ থেকে?
ইহুদিদের প্রতি ইউরোপজুড়ে নানা সময় বিদ্বেষমূলক মনোভাব দেখা গেছে। উল্লেখযোগ্য বিতাড়নের ঘটনাগুলো হলো:
🔸 মধ্যযুগে:
ইংল্যান্ড: ১২৯০ সালে রাজা এডওয়ার্ড প্রথম সকল ইহুদিকে বিতাড়িত করেন।
ফ্রান্স: একাধিকবার (১১৮২, ১৩০৬, ১৩৯৪ সালে) ইহুদিদের বিতাড়ন।
স্পেন: ১৪৯২ সালে ক্যাথলিক রাজারা "Alhambra Decree" জারি করে ইহুদিদের বিতাড়িত করেন।
পর্তুগাল: ১৪৯৭ সালে ইহুদিদের ধর্মান্তরে বাধ্য করা হয়।
🔸 আধুনিক কালে:
রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ: ১৮৮০–১৯০৫ সালে জারতন্ত্রের অধীনে বহু “পোগ্রোম” (ইহুদিবিরোধী সহিংসতা) ঘটে।
জার্মানি: হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি আমলে (১৯৩৩–১৯৪৫) ৬ মিলিয়নের বেশি ইহুদি গণহত্যার শিকার হয়।
এই নির্যাতনের ফলেই ইহুদিদের মধ্যে "Zionism" বা নিজস্ব রাষ্ট্রের দাবির আন্দোলন শুরু হয়।
---
🟦 Zionism আন্দোলন ও পশ্চিমা সমর্থন:
🔸 থিওডোর হার্জল ও রাজনৈতিক জায়োনিজম:
১৮৯৬ সালে থিওডোর হার্জল "The Jewish State" বইয়ে প্রথম বার বলেছিলেন, ইহুদিদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রয়োজন। ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রথম Zionist Congress অনুষ্ঠিত হয়।
🔸 বেলফোর ঘোষণা (Balfour Declaration, ১৯১৭):
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর একটি চিঠির মাধ্যমে জানায়—“We view with favour the establishment in Palestine of a national home for the Jewish people”। এটি ইসরায়েল গঠনের ভিত্তি প্রস্তুত করে।
---
🟦 ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের সময় ও জাতিসংঘের ভূমিকা:
🔸 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়:
১৯৪৫ সালে নাৎসি হত্যাযজ্ঞ বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়। তখন পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষত আমেরিকা ও ব্রিটেন ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।
🔸 জাতিসংঘ পরিকল্পনা (UN Partition Plan, ১৯৪৭):
জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি অংশে ভাগ করে—একটি ইহুদি রাষ্ট্র (৫৫% জমি), একটি আরব রাষ্ট্র (৪৫%) এবং জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক শহর ঘোষণা করে। ইহুদিরা এটি মেনে নেয়, আরবরা প্রত্যাখ্যান করে।
🔸 রাষ্ট্র গঠন (১৪ মে ১৯৪৮):
ডেভিড বেন গুরিয়ন ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। পরদিন পাঁচটি আরব দেশ (মিসর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক) আক্রমণ করে—যা প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ নামে পরিচিত।
---
🟦 কোন কোন পশ্চিমা দেশ সাহায্য করেছিল?
🔹 যুক্তরাষ্ট্র:
রাষ্ট্র ঘোষণার ১১ মিনিটের মধ্যে স্বীকৃতি দেয়।
সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সর্ববৃহৎ সহায়তা দেয়।
পরবর্তীতে ইসরায়েলকে বার্ষিক $৩.৮ বিলিয়ন পর্যন্ত সহায়তা দিয়েছে।
🔹 ব্রিটেন:
প্রথমদিকে ফিলিস্তিনে শাসক ছিল (British Mandate 1917–1948)। যদিও শেষ মুহূর্তে আরবদেরও খুশি রাখার চেষ্টা করেছিল।
🔹 ফ্রান্স:
১৯৫০–৬০-এর দশকে ইসরায়েলের পরমাণু কর্মসূচিতে সহায়তা করে।
---
🟦 আরব দেশগুলোর ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া:
🔸 আরবদের প্রত্যাখ্যান:
তারা জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনাকে "অবৈধ" মনে করে।
১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে চারবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
🔸 ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশা:
লাখ লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে আশেপাশের দেশে চলে যায়।
প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO) গঠিত হয় ১৯৬৪ সালে।
---
🟥 “আমেরিকার জারজ সন্তান” কেন বলা হয়?
এই শব্দবন্ধটি মূলত আরব ও মুসলিম বিশ্বে ব্যবহার হয় ইসরায়েলের প্রতি তীব্র বিরোধিতার প্রতীক হিসেবে। এর কারণ:
1. যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া সমর্থন: ইসরায়েলের সকল অন্যায়, দখল ও আগ্রাসনকে মার্কিন সমর্থন প্রাপ্ত হওয়া।
2. নৈতিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনেও প্রশ্রয়: ফিলিস্তিনিদের উপর হামলা, দখল ও বসতি নির্মাণে আমেরিকা কার্যত ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়ায়।
3. মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করা: আমেরিকা ইসরায়েলকে ব্যবহার করে আরব দুনিয়ার বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তার করে।
---
🟨 উপসংহার:
ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম একটি ঐতিহাসিক বেদনার ফসল—যেখানে ইউরোপীয় নির্যাতন, পশ্চিমা রাজনীতি, আরব বিভক্তি এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্ভাগ্য জড়িয়ে রয়েছে। যদিও ইসরায়েল নিজেদের একটি ঐতিহাসিক-ধর্মীয় দাবির ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন করে, কিন্তু এটি অনেকাংশেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনার ফসল, যার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের।
নিশ্চয়ই, নিচে একটি বিশ্লেষণধর্মী ও তথ্যভিত্তিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হলো:
"ফিলিস্তিনকেই কেন বেছে নেওয়া হলো ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের জন্য?"—এ বিষয়ে ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে লেখাটি সাজানো হয়েছে। এতে পক্ষ-বিপক্ষ যুক্তি, আন্তর্জাতিক ভূমিকা, এবং এর ফলাফল সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
---
📜 ফিলিস্তিনকেই কেন বেছে নেওয়া হলো ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের জন্য: এক ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
---
🟦 ভূমিকা:
ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি ২০শতকের সবচেয়ে বিতর্কিত রাজনৈতিক ঘটনার একটি। এটি শুধুমাত্র একটি রাষ্ট্রের জন্মই নয়, বরং একটি জাতির দীর্ঘ ইতিহাস, বাস্তুচ্যুতি, সংঘাত ও প্রতিরোধের প্রতিচ্ছবি। প্রশ্নটি স্বাভাবিক: পৃথিবীর এত দেশ থাকতে কেন ফিলিস্তিনেই ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করা হলো? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি এবং ঔপনিবেশিক চক্রান্তের গভীরে।
---
🟨 ১. ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দাবি: "ভূমি যেটি ঈশ্বর প্রদত্ত"
ইহুদিরা বিশ্বাস করে যে, ফিলিস্তিন অঞ্চলের (বিশেষ করে জেরুজালেমসহ প্রাচীন ক্যানান অঞ্চল) উপর তাদের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় অধিকার রয়েছে।
🔸 বাণী ও ধর্মগ্রন্থভিত্তিক দাবি:
তোরাহ ও বাইবেল অনুযায়ী, ঈশ্বর অব্রাহামের বংশধরদের (ইসরায়েলি গোত্র) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন “Promised Land” হিসেবে এই অঞ্চল।
প্রাচীন ইহুদি রাজ্য যেমন ইসরায়েল ও জুডাহ (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-৫৮৬) এখানেই অবস্থিত ছিল।
⚠️ কিন্তু—
এই ধর্মীয় দাবি প্রায় ২০০০ বছর আগেকার ইতিহাস, যেখানে পরবর্তীকালে ফিলিস্তিনে আরব, খ্রিস্টান, ও মুসলিমদের আবাস ও সভ্যতা গড়ে ওঠে।
---
🟨 ২. ইউরোপীয় অ্যান্টি-সেমিটিজম ও জায়োনিজমের উত্থান
🔹 ইউরোপে ইহুদি নির্যাতন:
মধ্যযুগ থেকে শুরু করে নাৎসি আমল পর্যন্ত, ইহুদিদের ইউরোপে বারবার বিতাড়ন ও গণহত্যার শিকার হতে হয়।
১৯৩৯–৪৫ এর নাৎসি গণহত্যা (হলোকাস্ট) ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের দাবি আরও তীব্র করে তোলে।
🔹 জায়োনিজম (Zionism) আন্দোলনের সৃষ্টি:
১৮৯৬ সালে থিওডোর হার্জল “The Jewish State” গ্রন্থে বলেন: “ইহুদি জাতির একটি নিজস্ব রাষ্ট্র চাই, যেখানে তারা নিরাপদে বাস করতে পারবে।”
জায়োনিস্ট কংগ্রেস ফিলিস্তিনকেই রাষ্ট্রের সম্ভাব্য এলাকা হিসেবে গ্রহণ করে। কেন?
---
🟨 ৩. ফিলিস্তিন কেন বেছে নেওয়া হলো?
✅ ধর্মীয় ঐতিহ্য:
ইহুদিদের বিশ্বাস অনুযায়ী এখানেই ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমি, সলোমনের মন্দির, এবং বাইবেলের যুগের স্মৃতি।
✅ ঐতিহাসিক প্রতীকী মূল্য:
"Zion" (জায়োন) শব্দটি আসলে জেরুজালেমের একটি পাহাড়ের নাম।
ফিলিস্তিনকে “মরুভূমিতে ফুল ফোটানো”-র প্রতীক বানানো হয় জায়োনিস্ট প্রচারণায়।
✅ বাস্তব রাজনৈতিক সুযোগ:
ফিলিস্তিন তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল (British Mandate of Palestine, ১৯১৭–১৯৪৮)।
ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের কাছে এটি ছিল “দখলযোগ্য এক ‘অপর’ জমি”।
---
🟨 ৪. পশ্চিমা ভূরাজনীতি ও সাম্রাজ্যবাদ
🔹 বেলফোর ঘোষণা (১৯১৭):
ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা দেয়:
> “We view with favour the establishment in Palestine of a national home for the Jewish people.”
এই ঘোষণার পেছনে ছিল—
ওসমানীয় খিলাফতের পতনের সুযোগে মধ্যপ্রাচ্য ভাগ করে নেওয়ার পরিকল্পনা।
ইহুদিদের সমর্থন নিয়ে যুদ্ধ জেতার কূটনৈতিক চাল।
🔹 জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনা (১৯৪৭):
ফিলিস্তিনকে দুইভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ:
ইহুদিদের ৫৫% জমি,
আরবদের ৪৫% জমি,
জেরুজালেম আন্তর্জাতিক এলাকা।
ইহুদি নেতারা তা মেনে নেয়, কিন্তু ফিলিস্তিনি ও আরবরা তা প্রত্যাখ্যান করে।
---
🟨 ৫. পক্ষ ও বিপক্ষ যুক্তি
✅ ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে যুক্তি:
যুক্তি ব্যাখ্যা
১. জাতিগত নিরাপত্তা ইউরোপে বারবার নির্যাতিত হওয়ায় ইহুদি জাতির নিরাপত্তার জন্য পৃথক রাষ্ট্র জরুরি।
২. ঐতিহাসিক দাবি ধর্মীয় ও প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী ফিলিস্তিনই ছিল ইহুদিদের মাতৃভূমি।
৩. জাতিসংঘ সমর্থন রাষ্ট্র গঠনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জাতিসংঘ থেকেই এসেছিল।
❌ ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের বিপক্ষে যুক্তি:
যুক্তি ব্যাখ্যা
১. ঔপনিবেশিক সহিংসতা ফিলিস্তিনে তখনও আরব মুসলিম ও খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। তাদের ইচ্ছা উপেক্ষা করা হয়।
২. গণবসতিচ্যুতি প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরছাড়া হয়; যাদের এখনও "শরণার্থী" হিসেবে গণ্য করা হয়।
৩. দ্বৈতনীতি ইউরোপ নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে ফিলিস্তিনকে বলি দেয়। ইহুদিদের নিরাপত্তার নামে আরবদের ভূমি কেড়ে নেওয়া হয়।
---
🟥 ফলাফল: দ্বন্দ্ব ও মানবিক বিপর্যয়
একাধিক আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ (১৯৪৮, ১৯৬৭, ১৯৭৩)
লাখ লাখ ফিলিস্তিনির উদ্বাস্তু জীবন
গাজা ও পশ্চিম তীরে সামরিক দখল, বসতি নির্মাণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন
স্থায়ী শান্তির অনুপস্থিতি
---
🟩 উপসংহার:
ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক রূপরেখায় ধর্মীয় আবেগময় দাবি হিসেবে উঠে এলেও, বাস্তবে এটি ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির একপেশে সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প, যার ফল ভোগ করছে ফিলিস্তিনি জনগণ আজও। একদিকে ইহুদি জনগণের নিরাপত্তার দাবি অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের স্বদেশ হারানো, চরম মানবিক সঙ্কট ও ৭৫ বছরের লড়াই—এই বাস্তবতাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
---
জেরুজালেম একটি ব্যতিক্রমী শহর, কারণ এটি তিনটি আব্রাহামিক ধর্ম—ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম—এই তিনটির কাছেই অত্যন্ত পবিত্র ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন।
নিচে ধর্মভেদে জেরুজালেম শহরের পবিত্রতা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হলো:
---
🕍 জেরুজালেম: কেন এত পবিত্র? (একটি ধর্মভিত্তিক বিশ্লেষণ)
---
🟦 ১. ইহুদি ধর্মে (Judaism):
🔹 কেন পবিত্র?
সলোমনের মন্দির (Solomon’s Temple):
ইহুদি বিশ্বাস অনুযায়ী, জেরুজালেমেই ছিল প্রথম এবং দ্বিতীয় ইহুদি মন্দির।
প্রথমটি নির্মাণ করেন রাজা সলোমন (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-এর আশেপাশে), যেটি পরে ধ্বংস হয়।
“Western Wall” বা “Wailing Wall”:
এটি দ্বিতীয় মন্দিরের অবশিষ্টাংশ। ইহুদিরা এখানেই দাঁড়িয়ে কান্না করে প্রার্থনা করে, কারণ এটি ঈশ্বরের সবচেয়ে কাছের স্থান হিসেবে বিশ্বাস করা হয়।
আর্ক অব কভেন্যান্ট:
ইহুদি ঐতিহ্যে বিশ্বাস করা হয় যে, ঈশ্বরের উপদেশসমূহ (Ten Commandments) রাখা হয়েছিল জেরুজালেমের মন্দিরে।
🔹 প্রতীকী অর্থ:
জেরুজালেম হলো “God’s chosen city”—ঈশ্বরের নির্বাচিত পবিত্র শহর।
এটি ইহুদি জাতিসত্তার ও ধর্মীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু।
---
✝️ ২. খ্রিস্টধর্মে (Christianity):
🔹 কেন পবিত্র?
যিশুর জীবন ও মৃত্যু:
খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, যিশুখ্রিস্টের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো—তাঁর শেষ খাবার (Last Supper), ক্রুশবিদ্ধ হওয়া (Crucifixion), এবং পুনরুত্থান (Resurrection)—সবই জেরুজালেমে ঘটে।
Church of the Holy Sepulchre:
এটি সেই গির্জা যেখানে যিশুর কবর রয়েছে বলে খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে। এটি বিশ্বের অন্যতম পবিত্র খ্রিস্টান তীর্থস্থান।
🔹 প্রতীকী অর্থ:
জেরুজালেম খ্রিস্টানদের জন্য “City of Salvation”—উদ্ধারের শহর।
বাইবেলে বলা হয়েছে, শেষ বিচারের দিন যিশু এখান থেকেই পুনরায় আগমন করবেন।
---
🟩 ৩. ইসলামে (Islam):
🔹 কেন পবিত্র?
আল-আকসা মসজিদ:
এটি ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান (মক্কা ও মদিনার পর)।
কুরআন অনুযায়ী, নবী মুহাম্মদ (সা.) মেরাজ (স্বর্গাভিযান) এর পূর্বে মসজিদুল হারাম (মক্কা) থেকে মসজিদুল আকসা (জেরুজালেম) ভ্রমণ করেন (সূরা আল-ইসরা ১৭:১)।
ডোম অব দ্য রক (Qubbat As-Sakhrah):
ইসলামি ঐতিহ্যে বিশ্বাস করা হয়, এখানেই নবী মুহাম্মদ (সা.) স্বর্গের পথে পা রেখেছিলেন।
🔹 ঐতিহাসিক দিক:
প্রথম কিবলা (নামাজের দিক) ছিল জেরুজালেম, পরে তা পরিবর্তন করে কাবা করা হয়।
ওমর (রা.) জেরুজালেম বিজয়ের পর শহরটি মুসলমানদের জন্য একটি পবিত্র কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
---
🌐 ৪. জেরুজালেম নিয়ে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংঘাত
ধর্ম পবিত্র স্থান দাবি
ইহুদি টেম্পল মাউন্ট, ওয়েস্টার্ন ওয়াল প্রাচীন মন্দিরের এলাকা
খ্রিস্টান চার্চ অফ হোলি সেপালখার যিশুর ক্রুশবিদ্ধ ও কবরস্থান
মুসলিম আল-আকসা ও ডোম অব দ্য রক মেরাজ ও প্রথম কিবলা
এই overlapping পবিত্রতার কারণে জেরুজালেমে প্রায়ই ধর্মীয় উত্তেজনা ও সহিংসতা ঘটে।
---
🟧 উপসংহার:
জেরুজালেম এমন একটি শহর যা শুধু একটি ধর্মের নয়, বরং তিনটি ধর্মের গভীর বিশ্বাস, ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের কেন্দ্র। এর প্রতিটি পাথর, প্রতিটি গলি বহন করে হাজার বছরের আধ্যাত্মিক আবেগ, বিশ্বাস ও সংগ্রামের ইতিহাস।
এই শহরের প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে এমন এক যৌথ উত্তরাধিকার, যা বিশ্বকে একদিকে ঐক্যের বার্তা দিতে পারত—কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে উঠেছে ধর্মীয়, ভূ-রাজনৈতিক ও মানবিক সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন