ইচ্ছা (পর্ব -৬)
গল্প: ইচ্ছা (পর্ব – ৬)
(নিঃশব্দ ধ্বংস, বিকেলের বিষ)
পাথরঘাটা গাঁয়ের চারপাশে এখন অনেক পরিবর্তন। গ্রামে পাকা রাস্তা হয়েছে, হাইস্কুলের সামনের মাঠে স্ট্রিট লাইট বসেছে, মোবাইল টাওয়ারের ছায়ায় পল্লির ছেলেমেয়েরা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে ছবি তোলে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, কিন্তু তার ফাঁকে ফাঁকে জমে আছে ভাঙা স্বপ্ন, অসম্পূর্ণ প্রেম, আর নীরব মৃত্যুর মতো অন্ধকার।
ইচ্ছা এখন আর আগের মতো দৌড়াদৌড়ি করে না, তার ঘর এখন খানিকটা সচ্ছল। রান্নার কাজের পাশাপাশি একজন ‘ভালো মানুষের’ ঘরের কাজ করে, যিনি দয়া করে তার ছেলের পড়াশোনার জন্যও আর্থিক সাহায্য করেন। তবে এই সাহায্য নিঃস্বার্থ নয়—ইচ্ছা জানে সে শুধু শ্রম নয়, নিজের শরীরও দিচ্ছে অল্প অল্প করে, দিনে দিনে। তাকে ভালোবাসা দেওয়া হয় না, শুধু একটুকরো নিরাপত্তা আর একটু বেশি দামী সাবানের গন্ধে মোড়া এক গ্লানি—যেটা ইচ্ছা নিজেই আর কাউকে বোঝাতে পারে না।
আদরের বয়স এখন আঠারো পেরিয়েছে। কলেজে ভর্তি হয়েছে দ্বিতীয় বর্ষে। রেজাল্ট খারাপ না—মাঝারি। ক্লাসের পড়ায় তার আগ্রহ কম, তবে নিজের মতো চালিয়ে যায়। কিন্তু চোখে মুখে এক ধরণের ধোঁয়া জমে থাকে—যা কেবল শরীরের ঘাম নয়, বরং আত্মার বিষ।
প্রথম দিকে আদর শুধু বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরত। পরে চুপিচুপি টানতে শুরু করে বিড়ি, সিগারেট, তারপর গাঁজা। একদিন এক বন্ধু “দোস্ত একটা ভালো জিনিস দিচ্ছি” বলে তাকে একটা প্যাকেট দেয়—ছোট্ট, সাদা। তার নাম হেরোইন।
প্রথমবার খেয়ে সে হাসে—ভয় পায় না। বরং যেটা ভয়ানক সেটা হলো, তার মনে হয় সে হালকা হয়ে গেছে, মাটির থেকে অনেক ওপরে ভাসছে। সেই অনুভূতিটা সে ফের পেতে চায়। এবং সেই চাওয়া তাকে টেনে নিয়ে যায় এমন এক পথে, যেখান থেকে ফেরার রাস্তা খুব কষ্টের, প্রায় অসম্ভব।
মা কিছু বুঝতে পারে না প্রথমদিকে। ছেলে মোবাইল ঘেঁটে রাত করে ফেরে, চোখ লাল, কথা কম। ইচ্ছা ভাবে বয়স হয়েছে, হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে রাত কাটায়।
একদিন সে ছেলেকে কোলে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে, “বাপ, তুই ঠিক আছিস তো? কিচ্ছু লুকাস না মায়ের কাছে।”
আদর বলে, “মা, আমি ঠিক আছি। শুধু ক্লাসের চাপ আর জীবনটা একটু কষ্টের লাগতেছে।”
ইচ্ছা বিশ্বাস করে। কারণ সে বিশ্বাস করতে চায়। কারণ মা তো সবসময় বিশ্বাস করে, যতক্ষণ না চোখের সামনে ছেলেকে ভেঙে যেতে দেখে।
কিন্তু ধীরে ধীরে গন্ধ বদলায়। ঘরে টাকা উধাও হয়, ফোনে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে।
একদিন ইচ্ছা দেখে, ছেলের চোখের নিচে কালি, পকেটে একটা সাদা চুনের মতো গুঁড়ো। সে জিজ্ঞেস করে, “এটা কী রে?”
আদর রেগে ওঠে, “তুই আমার পেছনে লাগছিস কেন? আমার ব্যক্তিগত জিনিস তুই কেন দেখবি?”
ইচ্ছা সেদিন চুপ করে যায়, কিন্তু মনটা ভেঙে পড়ে। সে জানে না কীভাবে কথা বলবে, কীভাবে ছেলে ফিরিয়ে আনবে। তার মনেও ভয় ঢুকে পড়ে—যদি একদিন আদর না ফেরে?
এদিকে সমাজের চোখ রাঙানি শুরু হয়। পাড়ার লোকজন ফিসফিস করে, “ইচ্ছার ছেলে নেশা করে। শুনছো? ওর মা নাকি এক গৃহস্থর ঘরে গিয়া গিয়া সময় কাটায়।”
ইচ্ছা মুখ নিচু করে হাঁটে। যে গর্ব নিয়ে এত বছর ছেলেকে মানুষ করেছে, সেই গর্ব যেন এখন তার বুকের পাঁজরে কাঁটার মতো বিঁধে।
আদরও বুঝতে পারে, তার মা তাকে এড়িয়ে চলে। তারা এক ঘরে থাকে ঠিকই, কিন্তু যেন দুই ভিন্ন গ্রহে বাস করে।
তাদের কথাবার্তা এখন এমন: – “মা, আজকে কলেজে যাচ্ছি না। মাথা ধরেছে।” – “ঠিক আছে, তবে খেয়ে নিস।” – “মা, একটু টাকা দে, একটা প্র্যাকটিক্যাল আছে।” – “আছে রাঁধনঘরে। নে নিয়ে নিস।”
এর বেশি নয়। কোনো আলাপ নেই, কোনো গল্প নেই। আগে তারা একে অপরের চোখে মুখে কথা বলত, এখন তারা শুধু দরজার পাল্লা দিয়ে আলাদা।
এভাবে চলে কিছু মাস। একদিন ইচ্ছা ছেলেকে ফলো করে। দেখে, আদর কলেজে যায় না। বরং শহরের এক কোণে, পরিত্যক্ত বাড়ির ছাদে বসে বন্ধুদের সঙ্গে, শরীর অর্ধজ্ঞান অবস্থায়, মুখে হাসি—চোখে গাঢ় ঘুম। ইচ্ছার বুক কেঁপে ওঠে।
সে ছুটে গিয়ে ছেলেকে তুলে নিয়ে আসে। আদর কিছু বোঝে না, কেবল মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে, “মা, আমি আর পারতেসি না।”
সেই রাতে ইচ্ছা তার ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “তুই যদি মরিস, আমি কার লাইগা বাঁচমু রে বাপ?”
আদর কাঁদে, কিন্তু পরদিন আবার চলে যায়। তার শরীর এখন নেশার গোলাম।
এদিকে ইচ্ছার “সাহায্যকারী” রফিকবাবু একদিন স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, “তোমার ছেলে যদি এভাবে চলতে থাকে, আমি আর তোমার দায়িত্ব নিতে পারব না।”
ইচ্ছা বোঝে, সে আসলে কখনোই সাহায্য পায়নি। কেবল বিনিময়ে শরীর দিয়েছিল, আর এখন তা-ও পুরনো হয়ে গেছে।
তার ভিতরটায় গর্জন ওঠে। সে একদিন ছেলেকে বলে, “আদর, তুই যদি সত্যি তুই হইয়া থাকিস, তবে এই ঘর ছাড়। নেশা কইরা মরবি তো মর, আমি আর পারি না।”
আদর তাকিয়ে থাকে, চুপ করে ঘর ছাড়ে না, কিছু বলে না। শুধু মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে যায় অন্য ঘরে, দরজা আটকে দেয়।
সেই রাতে ইচ্ছা কাঁথা মুড়ে কাঁদে। মনে হয়, এই ঘরটা কবরখানা হইয়া গেছে। এখানে শুধু শ্বাস আছে, প্রাণ নেই।
(চলবে...)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন