ইচ্ছা গল্প (পর্ব -৭)
গল্প: ইচ্ছা (পর্ব – ৭) (ঘরছাড়া, ফেরার টান)
পাথরঘাটার ভোরগুলো যেমন ধূসর, তেমনি ইচ্ছার জীবনটাও। চুপচাপ, নিরুপায়, অথচ বুকভরা অপেক্ষা। ছোট্ট ঘরের জানালায় মুখ রেখে প্রতিদিন সকালে সে ভাবে, "আদর কি ফিরবে আজ?"
আদর—যে একদিন হঠাৎই ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেদিন একটা চিরকুট ছাড়া আর কিছুই ফেলে যায়নি, "মা, টানাটানির দিন ফুরাবে, আমি টাকা পাঠাব, তুই চিন্তা করিস না।"
প্রথমে কলকাতা, পরে মুম্বই। কাজের অভাব নেই, কিন্তু ভাল চাকরি নেই। হোটেলে বেয়ারা, কখনো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কখনো কোনো গুদামে লেবারের কাজ, আবার রাতের শহরে সাউন্ড সিস্টেম টেনে আনার ঝক্কিও সামলেছে সে।
টাকা পাঠাতে শুরু করে—মাসে চার-পাঁচ হাজার। গাঁয়ে ফিরেই কেউ কেউ বলে, “ইচ্ছার ছেলে তো মুম্বইতে বড় চাকরি করে!”
ইচ্ছা চুপ করে। কাজ করতে করতে কেবল একবার ফোন দেখে, ‘₹৫৫০০ credited via PhonePe from Ador Mondal’। মুখে একটা নরম হাসি খেলে যায়।
কিন্তু সেই টাকা ঘরের চালচুলো ঠিক রাখে, সমাজের চোখ আর মুখ বন্ধ রাখতে পারে না।
পাড়ার রাস্তায় এখনো ফিসফাস, “বুঝলি, ইচ্ছা তো বিধবা, কিন্তু ওই লোকটার বাড়ি কাজ করতে গিয়ে...”
কেউ কেউ বলে, “মনে হয় ছেলেও ঠিক পথে নেই, ওই যে কত বড় শহরে থাকে, আর ঘন ঘন আসে না, একটা বউও তো দেখলাম না...”
ইচ্ছা সব শুনেও না শোনার ভান করে। মনে মনে ভাবে, “আমি তো শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম, আমি তো শুধু আদরকে মানুষ করতে চেয়েছিলাম। সমাজটা কেন বোঝে না?”
আদরও শোনে। কেউ ফোন করে বলে, “দোস্ত, তোদের পাড়ায় তোর মা নিয়ে অনেক বাজে কথা হয়।” কেউ আবার বলে, “তুই না থাকলে তোর মা হয়তো বাঁচত, তুই তো একটা বোঝা হয়ে এলি ওর জীবনে।”
এইসব কথা বুকের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে যায়। হঠাৎ কোনও সন্ধ্যায় খোলা ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতে ভাবে, “হয়তো ওরা ভুলও বলে না। আমি না থাকলে মা’র জীবন অন্যরকম হতো। বিয়ে করত, সংসার করত। আমি তো শুধু তাকে ভাঙার কারণ হলাম।”
এইসব ভেবেই সে বাড়ি ফেরা এড়িয়ে চলে। টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন করতে চায়, কিন্তু সম্পর্কটা ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে।
তবুও মাসে একবার ফোন করে, “ভালো আছিস মা?”
ইচ্ছাও অভিমান লুকিয়ে জবাব দেয়, “ভালোই আছি রে। কাজকর্ম করে দিন চলে যায়।”
তবুও কোনো উৎসব, পূজো বা দুর্গাপুজো এলেই মা বলে, “এবার না হয় একটু এসে যা?”
আদর বলে, “দেখি মা, অফিসে ছুটি মেলে কি না।” তারপর আর ফোন তোলে না কয়েকদিন।
এদিকে ইচ্ছার শরীর ভেঙে পড়তে শুরু করে। বারবার পেটের ব্যথা, মাথা ঘোরা, অনিদ্রা। ডাক্তার বলে, “তোমার শরীর এখন বিশ্রাম চায়।” কিন্তু বিশ্রাম তার কপালে নেই।
একদিন পাড়ার এক বৃদ্ধা আদরের এক বন্ধুর নম্বর জোগাড় করে ফোন করে, “তোর মা আর আগের মতো নেই, রে। অনেক দুর্বল। একবার হলেও এসে দেখা কর।”
সেই ফোনে আর থাকতে পারে না আদর। মুম্বই থেকে একটা পুরনো ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেয়। ট্রেনের জানালার ধারে বসে চারদিকের ভিড়ের মধ্যে সে কেমন যেন একা হয়ে যায়।
মনে পড়ে—শীতের রাতে মায়ের আঁচলে মুখ গুঁজে ঘুমানো, পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম পেন পাওয়ার খুশি, বিকেলের পড়ার ফাঁকে মায়ের ভাজা মুড়ি।
আর মনে পড়ে—লোকের মুখের কথা, অভিযোগ, আঙ্গুল তুলে বলা, “তোর মা ঠিক নয়।” সে ভাবে, “সব আমার জন্যই তো...”
পাথরঘাটায় ট্রেন থামে। পুরনো মাঠ, কাদার রাস্তা, নদীর গন্ধ, সবই যেন এক অচেনা রূপে ধরা দেয়। বাড়িতে ঢুকে দেখে, মা এক কোণে চুপ করে শুয়ে আছে। চোখ খোলা, কিন্তু জ্যোতি নেই।
“মা!”
ইচ্ছার চোখে জল এসে যায়, হাত বাড়িয়ে শুধু বলে, “তুই এলি?”
“তুই ডাকিস আর আমি না আসি?”
সেই রাত ভালোই কাটে। মা-ছেলে গল্প করে, রান্না হয় খিচুড়ি আর আলুভাজা। পাড়ার সবাই বলে, “আদর ফিরেছে!”
কিন্তু পুরনো বন্ধুরা চুপ করে না। পরের দিন সন্ধ্যায় কেউ একজন দরজায় এসে বলে, “চল রে ভাই, আজ সেই পুরনো দলের আড্ডা বসেছে।”
আদর ভাবে যাবে না। কিন্তু ভেতরটা কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে।
“একটুখানি, বেশি না। এরপর তো কলকাতায় ফিরে যাব, তখন কবে আবার...”
সেই একটুখানি থেকেই ফের শুরু হয় পুরনো অভ্যাস। পুরনো কু-সঙ্গ। কেউ হ্যাশ নিচ্ছে, কেউ ব্রাউন শুগার, কেউ বিয়ার টানছে—আদর সিগারেট ধরিয়ে শুধু বলে, “আজ একটু বসি, আর না।”
কিন্তু আসক্তির আবার শেষ কোথায়? যেখানে শুরু, সেখানেই আবার ফেরে মানুষ।
ইচ্ছা টের পায় কিছু একটা হয়েছে। ছেলে কেমন যেন অন্যমনস্ক, চোখ লাল, রাতে দেরিতে ফেরে।
একদিন খাওয়ার সময় সে বলে, “তুই আর ওই বন্ধুদের সঙ্গে যাবি না।”
আদর রেগে যায়, “তোকে সব কিছুতেই কেন বলার অধিকার আছে? আমার জীবনটা কি শুধু তোকে খুশি রাখার জন্য?”
ইচ্ছা কাঁপতে কাঁপতে চুপ করে যায়। খাওয়া বন্ধ করে দেয়।
রাতে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভাবে, “আমি তো শুধু ওর জন্যই বেঁচে ছিলাম, আজ সে আমাকেই বোঝা ভাবে?”
আদরও বিছানায় শুয়ে নিজেকে গাল দেয়, “আমি তো জানতাম, একদিন এই হবে। তাই তো ফিরতে চাইনি। আমি মা’কে কষ্ট দিতে চাই না।”
তবুও ভেতরে ভেতরে জানে, সে আবারও ভেঙে পড়েছে। মায়ের সেই ভালোবাসা, সেই আঁচলের গন্ধ যেন তার আসক্তি মুক্তির পথ হতে পারত, কিন্তু সে নিজেই সে পথ ছিঁড়ে ফেলেছে।
(চলবে...)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন