ঋণের ছায়া (ছোটোগল্প )



ঋণের ছায়া

একটি গ্রামীণ বাস্তবতা নির্ভর ছোটগল্প

গোপীনাথপুর গ্রামের মাটির গন্ধে ছিল শান্তি, কিন্তু এখন বাতাসেই যেন কিস্তির হিসেব ভাসে। শালবনের পেছনে যে ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর, সেখানেই বাস করে শ্যামল ও বিশ্বজিৎদের পরিবার। মা অমলা দেবী, বউ প্রতিমা আর পাঁচ বছরের ছেলে গুড্ডু—এই ছয়জনের সংসার।

শ্যামল কলেজে ইংরেজি অনার্স পাশ করে ফিরে এসেছিল মাথাভাঙা স্বপ্ন নিয়ে। সরকারি চাকরির পরীক্ষায় তিন বছর কাটিয়ে অবশেষে মাছের ব্যবসা শুরু করেছিল। বিশ্বজিৎ পলিটেকনিক পাশ করেও কাজ পায়নি; পেটের দায়ে এখন রাজমিস্ত্রির হেলপার। কষ্টের সংসারে প্রতিমার ইচ্ছা ছিল নার্সিং শেখার, তাই তিনি স্থানীয় একটি মাইক্রোফাইন্যান্স কোম্পানির লোনে ভর্তি হয়েছিলেন। স্যাররা বলেছিল, “এটা নারী ক্ষমতায়ন প্রকল্প, ইনসুরেন্স ফ্রি, সুবিধা অনেক।”

কিন্তু ফর্মে ইংরেজি পাতার পর পৃষ্ঠা, আর ইনসুরেন্সের নামে কেটে নেওয়া দুই হাজার টাকা। হাতে এল মাত্র উনিশ হাজার, তারও অর্ধেক গেল গুড্ডুর অসুস্থতায়। কোর্স তো দূর অস্ত। এরপর থেকেই শুরু হলো কিস্তির তাড়া।

প্রতিমা প্রথম কিস্তি দিতে না পারায় লোন অফিসাররা বাড়িতে এসে উচ্চস্বরে বকাবকি করল। “আপনারা তো শিক্ষিত লোক, মিথ্যে কথা বলার কি দরকার?”—কথার ঝাঁজে প্রতিমা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সমাজে মুখ দেখানোর মতো অবস্থা ছিল না। শ্যামল অপমান সহ্য না করে নিজের নামে আরও একখানা লোন নিল।

লোনের কিস্তির পেছনে পেছনে চলতে চলতে সংসারে ঢুকল দুশ্চিন্তা, গালি আর অসহায়তা। গুড্ডুর দুধ বন্ধ হল, প্রতিমা নিজেই রাতের খাওয়া ছেড়ে দিল। বিশ্বজিৎ শহরে গিয়ে নির্মাণ সাইটে কাজ নিল—দুই বেলার খাবারের জন্য।

এরই মাঝে শোনা গেল, পাশের গ্রামের বীণাদি কিস্তির চাপে আত্মহত্যা করেছেন। কোম্পানির লোকজন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে অপমান করেছিলেন। এই খবরে প্রতিমা অনেকক্ষণ বিছানায় চুপ করে বসে ছিল—মাথায় গামছা দিয়ে। গুড্ডুর কান্নার শব্দে চমকে উঠে বলল, “আমি বাঁচবো, শুধু ওর জন্য।”

একদিন বিশ্বজিৎ ফিরল এক নেতা-সাহেবের কাছ থেকে। বলল, “স্যার, আমাদের গ্রামে মেয়েরা মরছে কিস্তির চাপে।”
নেতা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, “ওসব কেন্দ্রীয় বিষয়, আমরা কিছু করতে পারি না।”

অমলা দেবী একরাতে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমরা কি শুধু হিসেবের খাতা? আমাদের যন্ত্রণা কারও চোখে পড়ে না?” শ্যামল আর বিশ্বজিৎ চুপ করে শুনেছিল, আর ঠিক করেছিল—এভাবে আর চলবে না।

তারা গ্রামের আরও কয়েকটি পরিবারকে নিয়ে একটি কমিটি গড়ল। বিডিও অফিসে গিয়ে লিখিত অভিযোগ জমা দিল। ছোট এক নিউজ পোর্টালে শিরোনাম উঠল—
“গোপীনাথপুরে কিস্তির জালে আটকে মরছে মানুষ, কেউ শোনে না”

সেইদিন গুড্ডু প্রথম হাসল, কারণ তার মা আবার খিচুড়ি রান্না করেছিল।
প্রতিমা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “আজ অনেকদিন পরে মনে হচ্ছে, হয়তো বাঁচা যাবে।”

শ্যামল পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “এই দেশ যদি শুধু ভদ্রলোকদের হয়, তবে আমরা গলা তুলে বলব—আমরাও মানুষ। আমরাও নাগরিক। আমরাও বাঁচতে চাই।”


শেষ নয়, এ কেবল শুরু।
গ্রামের বুকে জেগে উঠছে প্রতিবাদের ছায়া,
ঋণের ভারে নয়—
ভবিষ্যতের আশায় মাথা তুলে বাঁচার গল্প লিখছে গোপীনাথপুর।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...