রুবাই (মুর্শিদাবাদ বিষয়ক )চার লাইনের কবিতা
২১
মাটি ফাটে লিচু ফলায়, তবু পেট তো খালি,
হাটে বসে কৃষক বেচে স্বপ্নেরও হালি।
যে মাটিতে দাঁড়িয়ে দিচ্ছি সভা-ভাষণ,
সেই মাটি কি জানে তারই সন্তানের বাঁচন?
২২
তালপাতার পুঁথি মুছে গেছে ডিজিটালে,
তবু নেই স্কুলে খাতা, পেন্সিল বা খোঁজ পাল্টালে।
শব্দে শব্দে শিক্ষার আলো জ্বলার কথা,
কিন্তু ক্লাস ফাঁকা আজ — ভবিষ্যতের ব্যথা।
২৩
পালাশীর ক্যান্টনমেন্টে প্রথম বারুদ জ্বলে,
আজ সেই মাঠে কেউ খোঁজে না ইতিহাস বলে।
খেলো ছেলেমেয়ে ফুটবলে, তবু জানে না কিছু,
কোন পথে রক্ত পড়েছে, কোন বৃক্ষে ঝুলেছে পিছু।
২৪
নামি ডাক্তার পড়ে এখানকার ছেলে,
তবু তার বাবার পেশা – রাজমিস্ত্রি বলে।
বিদ্যে যায় শহরে, গ্রাম পড়ে থেকে,
আলোকিত সন্তান আসে না আর ফিরে দেখে।
২৫
নগরের লোক বলে, “ও তো শুধু বিঁড়ির দেশ”,
শুনে কাঁদে শিল্পী, যার হাতে গড়া রেশ।
হাসিমুখে সুর বাঁধে, গলায় গলায় সুর,
কিন্তু বাজারে মেলে না তার দামের গুরুতর।
২৬
উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ — ইতিহাসের নাম,
তবু দালালি পেরিয়ে পায়নি এই মাটি দাম।
যেখানে টাকা ছিল, আজ সেখানে ঋণ,
ব্যাঙ্কে ঘোরে কৃষক, মুখে শুকনো গিন্নি দিন।
২৭
মুর্শিদাবাদ বলে, “আমি তো দিল্লির দ্বার”,
মুর্শিদ কুলি খাঁ-র নামে ইতিহাস মুখভার।
তবু এখন ট্রেন চড়ে ভিনরাজ্যে যাওয়া,
ঘরে নেই রোজগার, পিঠে শুধু বোঝা।
২৮
কলেজে ছেলেরা পড়ে বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল,
কিন্তু চাকরি আসে না, ভেঙে যায় সে কোল।
চায়ের দোকানে চশমা পরে বসে থাকে,
ভাবনায় প্রবন্ধ — কিন্তু পকেটে ফাঁকা টাকা থাকে।
২৯
ধন থাকলে কাজ পায়, বিদ্যে থাকলে নয়,
এই হল মুর্শিদাবাদ — ভাগ্যের ভয়।
শিক্ষিত যুবা কাঁদে, ভাবে "দেশটা কার?"
একদিকে ভবিষ্যৎ, আরেকপাশে দেওয়াল পার।
৩০
ছেলেটি গাইছে, গলার সুরে ঝরে আগুন,
তবু তার গ্রামে নেই বিদ্যুৎ, নেই জলনল কোনো খোঁজ।
আলো না এলে সুর কেমনে জন্ম নেবে?
সংগীতের সন্তানও আলো চায়, প্রভাত খোঁজে।
---
৩১
কাঁসা-পিতলের বাটিতে আজ আর ভাত পড়ে না,
অতীতের ঢাক বেজে ওঠে, কিন্তু ভবিষ্যৎ গড়া না।
হাতে যাদের সোনা ছিলো কাজে আর শিল্পে,
আজ তারাই ভিখারি বনে বাঁচে নামমাত্র টিকতে।
৩২
পত্রিকার পাতায় লেখা – ‘বিকাশের নাম’,
কিন্তু গ্রামের ছেলেরা হেঁটে পাড়ায় সন্ধ্যাবেলা থাম।
চাকরি নেই, কাজ নেই, শুধু অভিমান,
যে গ্রাম গড়েছে রত্ন, আজ নিঃস্ব তার প্রাণ।
৩৩
ছানাবড়া চেনে দেশ, খায় শহরের লোক,
কিন্তু কার হাতে গড়া সে? সেই গল্প থাকে শোক।
জি আই ট্যাগ এল, গরিমাও এল,
কিন্তু শিল্পীর ঘরে আজো খালি হাঁড়ি মেল।
৩৪
বহরমপুর নাম করে মঞ্চে ভাষণ,
কিন্তু নিচে পড়ে থাকে শ্রমিকের কান্না রোজন।
ভদ্রলোক হাসে, ক্লাবে বসে চা খায়,
আসল যারা মাটির, তারা চুপ করে যায়।
৩৫
চারণ কবি গুমানী গেয়েছিলেন কথা,
আজ কেউ শোনে না সে গানের ব্যথা।
লোকসংগীত চাপা পড়ে ডিজে বাজনায়,
ক্লাবে ক্লাবে গায় আর, মাঠে শুধু হাহাকার।
৩৬
উৎসব আসে, মেলা বসে, ব্যানার ওঠে,
তবু হাটে পয়সা নেই, শুধু ধারের রটে।
কৃষকের কষ্ট ঢাকে উৎসবের রঙ,
অভাবের গল্প গোপন করে ঢাকের ঢং।
৩৭
লিচু বাগানে ফল ফুটে — লাল টুকটুকে স্বপ্ন,
কিন্তু চাষির হাতে পড়ে শুধু ক্ষতরূপে যন্ত্রণা।
মধ্যস্বত্ত্বভোগী পায় লাভের ভাগ,
চাষি পায় ঋণ আর ব্যাংকের কাগজ-পাগল দাগ।
৩৮
স্কুলে শিক্ষক আসে না, বেতন ঠিক যায়,
ছাত্রেরা জানে না ভূগোল, ইংরেজি ক’পায়।
তবু পাশ করায় সবাই, যেন এক ভেল্কি,
শিক্ষার রাজ্যে চলছে অবহেলার খেলছি।
৩৯
পুতুল নাচ, মুখোশ শিল্প – হারিয়ে গেলো,
শহরের হাটে দাম নেই, তারা এখন ফেলে।
বাউল সুর, কবিয়াল গান মুছে ফেলে ফোনে,
ঐতিহ্য হাঁটে নীরবে, কাঁদে শহরের কোণে।
৪০
তবু এখনো রোদ পড়ে গঙ্গার জলে,
মাটির গন্ধ ওঠে সন্ধ্যার তলে।
মুর্শিদাবাদ আজও বাঁচে তার প্রাণে,
তবে দরকার চোখ – যে দেখে, এবং মানে।
ক্রমশ...
বিস্তারিত পড়তে
https://whatsapp.com/channel/0029VaAZ2zPCnA7m0XY2hY3C
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন