ইচ্ছা ( পর্ব -৫)
গল্প: ইচ্ছা (পর্ব – ৫)
(চুপচাপ ফাটল, অলক্ষ্যে আগুন)
পাথরঘাটা বদলাচ্ছে। না, একেবারে শহর হইয়া ওঠেনি ঠিক, তবে পুরান বাজারের পাশে নতুন ঘর উঠছে, মোবাইল টাওয়ার বসেছে, ইন্টারনেটের রিচার্জে গান শুনছে পাড়ার ছেলেপুলে। সেই বদলের হাওয়ায় হালকা একটা স্বস্তির গন্ধ আছে। আর তারই ফাঁকে, ইচ্ছা আর আদরের ঘরেও বদল এসেছে।
ইচ্ছা এখন আগের চাইতে বেশি আয় করে। লোকের বাসার রান্না, ছাদে গার্মেন্টসের কাজ, আর এক বাড়ির বৃদ্ধ মাসিমার দেখাশোনার দায়িত্ব—এইসব কইরা মাস গেলে একটা মোটা টাকার রোজগার হয়। ঘরে এসেছে একটা পুরান ফ্যান, একটা রঙচটা টিভি, আর মাটির বিছানার বদলে কাঠের খাট।
এই বাড়িতেই কাজ করতে করতে ইচ্ছার জীবনে ঢোকে রফিকবাবু। সেজে-গুজে অফিস যায়, তার স্ত্রী থাকে বাইরে। মাসিমার দূর সম্পর্কের ভাগ্নে, মাঝে মাঝেই আসে, আর ইচ্ছার রান্না খেয়ে বলে, “তুমি তো খুব গুছিয়ে কাজ করো, ইচ্ছাদি।”
এই “ইচ্ছাদি” ডাকটা অদ্ভুত ঠান্ডা, মোলায়েম, আর অনেকদিন পর কেউ তার দিকে এমনভাবে তাকায়। শুরুতে ইচ্ছা অবাক হয়েছিল, পরে সেটা অভ্যাস হয়ে যায়।
কিন্তু এ সম্পর্ক ছিল শুধুই রফিকবাবুর ইচ্ছেমতো। সময়মতো আসে, সময়মতো চলে যায়। মুখে ভালোবাসার কথা বলে, কিন্তু হাত খালি রাখে। ইচ্ছার জীবনে সে একটা ছায়া হয়ে থাকে—যেটা লুকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু উপেক্ষা করা যায় না।
অন্যদিকে আদর এখন কলেজে পড়ে। প্রথম বছর কোনো মতে পাস করে গেছে। কিন্তু ক্লাসে মন নেই তার। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, খোলা মাঠে বাইক শেখা, পাড়ার এক নীচু দোকানে চা খাওয়ার ছলে সিগারেট, গাঁজার গন্ধে সারা রাতের অলসতা—এটাই এখন তার নিত্যদিনের চেহারা।
তবে সামনে সে ভদ্র, ধর্মপালনে মনোযোগী। শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়ে, মা-কে বলে, “মা, সব ঠিক আছে। আমি খারাপ কিছু করি না।” বাড়ির পেছনে সেজদায় মাথা ঠেকায়—আসলে নিজের ভিতরের অন্ধকার ঢাকতে চায় বাইরের ধার্মিকতার চাদরে।
ইচ্ছা সন্দেহ করে না। বা, হয়ত করে, তবু মুখ ফুটে বলে না কিছু। কারণ সে নিজেও নিজের ভিতর ডুবে গেছে অন্য সম্পর্কের কুয়াশায়।
এখন তাদের সম্পর্ক একরকম “টাকা দাও, বই কিনব”, “আজ কলেজে ক্লাস আছে, ফিরতে দেরি হবে”—এইরকম কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আগে মা-ছেলের মাঝে যে গভীর গল্প ছিল, মুখে মুখে যেটা আলো জ্বালত—তা এখন নিভু নিভু।
একদিন রাত্তিরে ইচ্ছা জিজ্ঞেস করে, “তোর বইপত্র কই রে? কয়েকদিন দেখতেসি না।”
আদর বলে, “মা, তুই খালি সন্দেহ করিস। আমার নিজেরও তো একটু জীবন আছে।”
ইচ্ছা চুপ করে যায়। আর মনেই হয়, এ ছেলে যেন দিনে দিনে তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অথচ শরীরের ভিতর তারই রক্ত, কিন্তু মনের ভিতর অন্য কেউ—যাকে সে চিনে না।
একদিন পাড়া থেকে কানাঘুষো আসে—“ইচ্ছার ছেলে নাকি নেশা করে।”
ইচ্ছা মুখে হাসে, “না না, আমার আদর এরকম হইতে পারে না।”
তবে রাতে, ছেলের চোখে তাকিয়ে সে দেখে—লালচে রঙ, অন্যমনস্ক চাহনি, আর এমন এক ঘোর যেন শরীর আছে, মন নেই।
এইভাবে মা-ছেলের ঘরটা একটু বেশি ঝকমকে হলেও, ভিতর থেকে ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে।
এখন আদর চাইলেই টাকাপয়সা পায়, মা জিজ্ঞেস করে না কেন লাগবে। ইচ্ছা চাইলেই কারো কাছ থেকে আদরের নাম নিয়ে “ভালোবাসা” দাবি করে, অথচ জানে, শেষমেশ তাকে শুধু ব্যবহারই করা হয়।
একদিন রাতে বিদ্যুৎ চলে যায়। অন্ধকারে ইচ্ছা মাটিতে বসে থাকে, আদর খাটের কোণে মোবাইলে মুখ গুঁজে। কোথাও কোনো কথা নেই। শুধু বাতাসের শব্দ, আর সেই শব্দের ফাঁকে যেন শোনা যায়—একটা সম্পর্ক ভাঙার শব্দ, নিঃশব্দে।
এই সংসার এখনও একসাথে আছে, কিন্তু শুধু প্রয়োজনের দড়িতে বাঁধা। ভালোবাসা বা বোঝাপড়ার গন্ধ নেই।
এভাবেই সময় পেরোয়, এবং সামনে এগিয়ে আসে নতুন ছায়া, যা বদলে দেবে তাদের ভবিষ্যৎ।
---
(চলবে...)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন