ইচ্ছা ( পর্ব -৮)
গল্প: ইচ্ছা (পর্ব – ৮) (প্রেম, সংসার আর অদৃশ্য ফাটল)
আদরের জীবন যেন বারবার বৃত্তে ঘোরে। একবার গাঁ, একবার শহর। একবার মা, একবার নিজেকে হারানো। তবে এবারের ফেরা একেবারেই আলাদা। এক ধরনের ক্লান্তি, এক ধরনের তৃষ্ণা তাকে গাঁয়ে টেনে আনে। শহরের কোলাহলে যেখানে কেউ তার খোঁজ রাখে না, সেখানে একটুকরো নিঃশ্বাসের জায়গা খুঁজতে সে ফিরে আসে।
ইচ্ছা তখন অনেকটাই অসুস্থ। কিন্তু ছেলের ঘরে ফেরা যেন তার চোখেমুখে নতুন আলো এনে দেয়। রোজকার কষ্ট, অভাব, সমাজের কটুক্তি—সব যেন ধুয়ে যায়।
বাড়ি ফিরে আদর সিদ্ধান্ত নেয়, এবার আর ভাঙা জীবন নয়। মায়ের সঙ্গেই থেকে কিছু একটা করবে। ছোট্ট একটা মোবাইল সারাইয়ের দোকান খোলে পাথরঘাটার হাটের পাশে। কাজ একটু একটু করে জমে। গ্রামের স্কুলে ইলেকট্রিক বাল্ব বদল, টিউশন পড়ুয়াদের মোবাইল ঠিক করা—চলতে থাকে সংসার।
ঠিক তখনই নতুন করে জীবনে আসে ভালবাসা। মামার মেয়ে—শবনম বানু। ডাকনাম হিয়া।
হিয়া ছোটবেলা থেকেই আদরের চেয়ে দু’বছরের ছোট। খেলে বড় হয়েছে একসঙ্গে। তবে জীবনের নানা ধাপে সেই সম্পর্ক ফিকে হয়ে গিয়েছিল। আবার হঠাৎ একদিন পুকুরপাড়ে দেখা, আর সেখান থেকেই এক অদ্ভুতভাবে গাঢ় হতে শুরু করে সম্পর্ক।
“তুই থাকবি তো এখানে?”
“হ্যাঁ। এবার আর কোথাও যাব না। মা আছে, তুই আছিস।”
“তুই পালিয়ে পালিয়ে বাঁচিস না তো?” – হিয়ার প্রশ্নে একটা অদ্ভুত লাজুক হাসি দেয় আদর।
পুকুরপাড়ের কচুপাতায় জমা জলের মত সেই ভালোবাসা, একটানা শব্দহীন, শান্ত, অথচ গভীর।
ছ'মাসের মধ্যে দু'জনের বিয়ে হয়। পাড়ায় কানাঘুষো কম হয় না, কিন্তু এ বারে ইচ্ছা দাঁত-কামড়ে মুখ বন্ধ রাখে। আদর বলে, “তুই কিচ্ছু শুনবি না মা। এবার আমি সামলাব।”
বিয়ের পরে ইচ্ছা যেন নতুন করে বাঁচে। ঘরে মানুষের হাসি, বউমার হাতে রসনা। পাড়ার কিছু লোক মুখ বেঁকিয়ে বললেও অনেকেই বলে, “আদর তো অনেক বদলেছে।”
দুই বছর এভাবেই কাটে। হিয়া আর আদরের মধ্যেও প্রেমের আলো নিভে যায় না। সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করে ফিরে আদর বলত, “তোর হাতের চা-টা না খেলে মন টাকে ভারী লাগে।”
হিয়া হেসে বলত, “তুই যে কথায় কথায় এমন রোম্যান্টিক হস!”
তবে যে সুখ সবার সহ্য হয় না, তার মেয়াদও নশ্বর। তৃতীয় বছরে পাড়ার কানাঘুষো ফের মাথা তোলে।
“ওদের তো বিয়ে হয়েছে তিন বছর, এখনো বাচ্চা নেই?”
“কে জানে, মেয়ের দোষ না ছেলের?”
ইচ্ছা প্রথমে চুপ করে। পরে একদিন হিয়াকে বলে, “মা, কোনো ডাক্তারের কাছে যাস একবার।”
হিয়া থমকে যায়, “তুইও বিশ্বাস করলি, আমার দোষ?”
আদর মাঝখানে পড়ে যায়। সে ভাবে, “সমাজ তো মায়ের মুখ দিয়েই কথা বলে। আমি কাকে দোষ দেব?”
এরপর শুরু হয় দূরত্ব। রাতে হিয়া মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকে। কথা কমে যায়। আদর কথা বলতে গেলেও হিয়া উত্তর দেয় না, “তুই যা বলিস, আমি শুনে নিই।”
আদর ভাবে, “তুই কি আর আমাকে ভালবাসিস না?”
হিয়া শুধু চোখের কোণে জল এনে বলে, “ভালবাসি, তাই তো সহ্য হয় না। একেক সময় মনে হয়, এই সংসারটাই যদি না হত, তাহলে এত দোষী মনে হত না নিজেকে।”
এই কথাগুলো যেন আদরের ভিতরে একটা কালো গর্ত বানিয়ে দেয়। দোকানের কাজেও আর মন বসে না।
মায়ের সঙ্গে কথাও কমে যায়। ইচ্ছা ভাবে, “ছেলেটা আবার বুঝি বদলাচ্ছে?”
একদিন সকালে আদর দাঁড়িয়ে থাকে পুকুরপাড়ে, হঠাৎ বলে, “মা, আমি আবার শহরে যাব।”
ইচ্ছা চোখ তুলে বলে, “তুই কি পালাচ্ছিস?”
“না মা, নিজেকে খুঁজতে যাচ্ছি।”
হিয়া বলে, “তুই গেলে আমি কী করব?”
“তোকে ফেলে যাচ্ছি না হিয়া, শুধু একটু দূরে যাচ্ছি... যেন তোকে নতুন করে পেতে পারি।”
কলকাতায় ফের কাজ শুরু হয়। এবার সে একটা ইলেকট্রিক্যাল কনট্রাক্টর ফার্মে কাজ পায়। টাকা ভালো পায়, নিয়মিত বিকাশে পাঠায়। হিয়ার জন্য জামা, শাড়ি, মায়ের জন্য ওষুধের খরচ সব পাঠায়।
তবে ফোনে কথা হয় কম। হিয়ার কণ্ঠস্বর বদলে গেছে—একটু কষ্ট, একটু অভিমান, আর একটু আশা।
মা-ও ফোন ধরে, “খোকা, ঠিক আছিস তো?”
আদর শুধু বলে, “চেষ্টা করছি মা।”
শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকে, “যাদের সব ছিল, তারাও কষ্ট পায়। আমার তো কিছুই ছিল না, তবু আমি সবাইকে খুশি রাখতে চেয়েছিলাম।”
কিন্তু সেই চেষ্টাতেও যেন অদৃশ্য ফাটল থেকে যায়—ভালোবাসা, সংসার, দায়িত্ব, আত্মবিস্মৃতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আদর বুঝতে পারে—সুখ শুধু পেতে জানলে নয়, ধরে রাখতেও জানতে হয়। আর সমাজ? সে তো শুধু রটায়, বোঝে না।
(চলবে...)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন