ইচ্ছা ( পর্ব -৯)
গল্প: ইচ্ছা (পর্ব – ৯) (ছায়া ছায়া সম্পর্ক, বন্ধুত্ব না কলঙ্ক?)
আদরের জীবন যেন বারবার এক জায়গায় এসে থেমে যায়। কখনো হঠাৎ প্রেমে, কখনো সমাজের কটু কথায়, কখনো নিজের ভিতরের অবসাদে। কলকাতায় কাজ চলছিল ভালোই, তবে সেই একঘেয়েমি, একাকীত্ব যেন ফের বুক চেপে ধরে। বাড়ির থেকে দূরে থাকায় মায়ের ফোন আসত কখনো সপ্তাহে একদিন, কখনো দশ দিনে। হিয়া প্রথমদিকে নিয়মিত ফোন করলেও এখন রুটিনে গিয়ে পড়েছে – “খেয়েছিস?” “ভালো আছিস তো?” – ব্যস।
এই ফাঁকে আদরের মনে দানা বাঁধে এক নতুন চিন্তা। তার বাবা যিনি বহু বছর আগেই মারা গেছেন, তার আগের পক্ষের একটা ছেলে নাকি কলকাতায়ই থাকে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, লোকটা এক কাপড়ের দোকানে কাজ করে।
তাদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়। প্রথম দিকে দূরত্ব থাকলেও ধীরে ধীরে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে দাদা, তাকে একদিন নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। ওখানেই পরিচয় হয় তার দুই মেয়ের সঙ্গে – পিয়ালী আর রুমকি।
পিয়ালী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ইংরেজি অনার্স। রুমকি ক্লাস টেন। ওদের সঙ্গে আদরের এক আলাদা ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়। দাদা-বোনের মতন। আদরের মনে হয়, এত বছর পর এই শহরেও কেউ আছে, যে ওর ভালো-মন্দ জানতে চায়, মন খুলে কথা বলতে পারে।
একদিন পিয়ালীকে বলল, “তুই জানিস? কখনো কখনো মনে হয়, নিজের কথা বলার জন্য কেউ নেই আমার। মা নিজে অত কষ্ট করে বড় করেছে, তার কাছে মন খোলার সাহস পাই না। হিয়া... ও তো এখন শুধু সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আমি একা।”
পিয়ালী কিছু বলে না। শুধু বলে, “তুমি চাইলে আমি আছি।”
সেই সম্পর্ক একসময় এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে যে, আদর প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ওদের বাড়ি যেত। একসঙ্গে সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া—সবই বন্ধুত্বের ছাতার নিচে।
কিন্তু সমাজ কি এতটা উদার? গ্রামের লোকেরা একবার জানার পরে শুরু হয় কানাঘুষো।
“আদর না কি দাদার বাড়ির মেয়ের সঙ্গে খুব ওঠাবসা করছে?”
“হিয়ার বাচ্চা হচ্ছে না বলেই কি অন্যদিকে মন?”
“ওর মা-ও তো অত সোজা ছিল না, ছেলেও বোধহয় চালে চটে গেছে।”
এই কথাগুলো হিয়ার কানে গিয়ে পৌঁছায়।
একদিন ফোনে হিয়া বলে, “তুই কী করিস কলকাতায়?”
“কাজ করি, জানিস তো।”
“না, আমি শুনেছি তুই খুবই ব্যস্ত অন্য কিছুর সঙ্গে।”
আদর থমকে যায়। “মানে?”
“তুই পিয়ালী নামে একটা মেয়ের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করিস না?”
আদর চুপ। কিছু বলার ভাষা পায় না।
মা ইচ্ছাও গ্রামের বাজারে শুনে আসেন, “তোমার ছেলে তো বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে, বুঝলে না? কলকাতায় বিয়ের পরে আবার নতুন সম্পর্ক!”
ইচ্ছার মুখ শুকিয়ে যায়। একদিন ফোনে ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন, “তুই ঠিক আছিস তো, খোকা?”
আদর বুঝে যায়, সমাজ যেভাবে আঁচ দেয়, সেই আঁচ কখনো শুধু গায়ে লাগে না—মনেও পড়ে তার রেশ। সে আবার নিজের ভিতরে গুটিয়ে যেতে থাকে। পিয়ালীকে কিছু বলে না, দূরে সরে যায়। দোকানে কাজ করে, রাতে ঘরে ফিরে নিরবতা।
একদিন রাতে ফেসবুকে একটা পুরনো বন্ধু হঠাৎ চ্যাট করে—তপন, যে এককালে মুর্শিদাবাদে তার খেলার সাথী ছিল।
“কিরে, কলকাতায় কেমন আছিস?”
“বেঁচে আছি।”
“আয় একদিন, দেখা হবে।”
তপনের সঙ্গে দেখা হয়। সে এখন একটা বিয়ে বাড়ির লাইটিং-এর কাজে যুক্ত। হাতে টাকা, গাঁজা, মদের যোগান সবই সহজলভ্য। প্রথম প্রথম আদর না বললেও একদিন রাতে ক্লান্ত হয়ে হঠাৎ একটা পাফ নেয়।
মনে হয়, “এইটুকু স্বস্তি তো দরকার। এত চিন্তা, এত দুঃখ, কিছু তো ভুলতে হবে!”
এইভাবেই আবার এক পুরনো অভ্যাস চুপি চুপি ফিরে আসে।
একদিন ইচ্ছা কলকাতায় ছেলের কাছে আসে। মুখ শুকনো দেখে, আচরণ বদল দেখে বুঝতে পারে কিছু একটা গড়বড়।
“খোকা, তুই আবার সেই ভুল পথে হাঁটছিস না তো?”
আদর কিছু বলে না। চোখ নামিয়ে রাখে।
হিয়া ফোনে কাঁদে। “তুই যদি পালিয়ে থাকিস, আমি কোথায় যাব?”
আদর ভাবে, “এই আমি কি সত্যিই ভালোবাসতে জানি? না কি শুধু নিজের কষ্ট ভুলতে গিয়ে অন্যদের কষ্ট দিই?”
তবু সে ঠিক করে, এবার নিজের ভিতরে হারিয়ে নয়—নিজেকে সামলে নতুন করে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু সেই দাঁড়ানো কি এত সহজ?
(চলবে...)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন