আবদুল ওয়াহাব ধর্মীয় নেতা থেকে একছত্র ক্ষমতা অধিপত্য লাভ করল কিভাবে

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব কে ছিলেন?

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩–১৭৯২) ছিলেন একজন আরব ধর্মীয় পণ্ডিত, সংস্কারক এবং ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আরব উপদ্বীপের নাজদ অঞ্চলের উয়াইনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হানবালি মাজহাবের একজন অনুসারী ছিলেন এবং ইসলামের একটি কঠোর, পিউরিটানিক্যাল ব্যাখ্যা প্রচার করেন, যা তৌহিদ (একত্ববাদ) এবং শিরক (বহুখোদাবাদ) পরিহারের উপর জোর দেয়। তাঁর মতে, তৎকালীন মুসলিম সমাজে বিভিন্ন বিদআত (ধর্মীয় উদ্ভাবন) এবং শিরক প্রচলিত ছিল, যেমন কবর পূজা, সুফি আচার-অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রথা, যা তিনি ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক মনে করতেন।তাঁর প্রধান গ্রন্থ, কিতাব আত-তৌহিদ (তৌহিদের বই), তাঁর ভাবধারার মূলনীতি ব্যাখ্যা করে। তিনি ইসলামকে তার মতে প্রাথমিক রূপে (সালাফি পদ্ধতি) ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে "ওয়াহাবি" আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

তথ্যসূত্র:Natana J. DeLong-Bas, Wahhabi Islam: From Revival and Reform to Global Jihad (2004): আবদুল ওয়াহাবের জীবন ও ভাবধারার বিস্তারিত বিবরণ।David Commins, The Wahhabi Mission and Saudi Arabia (2006): 

ওয়াহাবি আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।কীভাবে তিনি মুসলমানদের নেতৃত্ব দিতে পারলেন?মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব মুসলমানদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সফল হন মূলত তাঁর ধর্মীয় প্রচারণা, রাজনৈতিক জোট এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে। 
নিচে এর প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো:

১. ধর্মীয় প্রচারণা ও আদর্শতৌহিদের উপর জোর: 

আবদুল ওয়াহাব ইসলামের মূল শিক্ষা হিসেবে তৌহিদের উপর জোর দেন এবং শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। তিনি দাবি করেন যে তৎকালীন মুসলিম সমাজ ইসলামের প্রকৃত পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তাঁর এই বার্তা ধর্মীয় পুনর্জাগরণের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছিল, বিশেষ করে নাজদের মতো অঞ্চলে, যেখানে স্থানীয় জনগণ ধর্মীয় সংস্কারের প্রতি আকৃষ্ট হয়।শিক্ষা ও প্রচার: তিনি মক্কা, মদিনা এবং বসরায় ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ফিরে এসে নাজদে তাঁর ধর্মীয় বার্তা প্রচার শুরু করেন। তিনি সাধারণ মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতেন এবং তাঁর সহজবোধ্য ভাষা ও কঠোর ধর্মীয় অবস্থান অনেককে আকৃষ্ট করে।

তথ্যসূত্র:John Voll, Muhammad Hayya al-Sindi and Muhammad ibn Abd al-Wahhab: An Analysis of an Intellectual Group in Eighteenth-Century Madina (1977): আবদুল ওয়াহাবের শিক্ষা ও প্রচারণার প্রভাব।

২. আল-সৌদ পরিবারের সাথে জোটমুহাম্মদ ইবনে সৌদের সাথে চুক্তি (১৭৪৪): 
 আবদুল ওয়াহাবের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল দিরিয়ার শাসক মুহাম্মদ ইবনে সৌদের সাথে তাঁর জোট। এই চুক্তির মাধ্যমে আবদুল ওয়াহাব ধর্মীয় নেতৃত্ব দেন, আর ইবনে সৌদ রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি প্রদান করেন। এই জোট ওয়াহাবি ভাবধারাকে রাজনৈতিক শক্তির সাথে যুক্ত করে এবং আরব উপদ্বীপে প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হয়।ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সমন্বয়: এই জোটের মাধ্যমে ওয়াহাবি ভাবধারা শুধু ধর্মীয় আন্দোলনই থাকেনি, বরং একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আল-সৌদ পরিবার ওয়াহাবি ভাবধারাকে তাদের শাসনের ধর্মীয় ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে, যা তাদের শাসনকে বৈধতা প্রদান করে।

তথ্যসূত্র:Madawi Al-Rasheed, A History of Saudi Arabia (2002): আল-সৌদ ও আবদুল ওয়াহাবের জোটের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ।Alexei Vassiliev, The History of Saudi Arabia (1998): প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের উত্থান ও ওয়াহাবি ভাবধারার ভূমিকা।

৩. সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটনাজদের সামাজিক অবস্থা: 
 ১৮শ শতাব্দীতে নাজদ অঞ্চল ছিল তুলনামূলকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ। আবদুল ওয়াহাবের কঠোর ধর্মীয় বার্তা এই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে একটি নৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতিশ্রুতি হিসেবে গৃহীত হয়। তাঁর শিক্ষা স্থানীয় বেদুঈন সম্প্রদায় ও শহুরে জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে।ওসমানীয় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া: তৎকালীন ওসমানীয় শাসনের প্রতি অনেক আরবের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। আবদুল ওয়াহাবের ভাবধারা এই অসন্তোষকে ধর্মীয় আন্দোলনের রূপ দেয়, যা স্থানীয় নেতাদের সমর্থন পায়।

তথ্যসূত্র:Guido Steinberg, Religion and State in Saudi Arabia (2006): নাজদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।Eugene Rogan, The Arabs: A History (2009): ওসমানীয় শাসনের প্রেক্ষাপটে আরব আন্দোলন।

৪. নেতৃত্বের কৌশলধর্মীয় কর্তৃত্ব: 
 আবদুল ওয়াহাব নিজেকে একজন ধর্মীয় পণ্ডিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি ফতোয়া জারি করতেন এবং ধর্মীয় বিতর্কে অংশ নিতেন, যা তাঁর কর্তৃত্ব বাড়ায়।সামরিক সমর্থন: আল-সৌদের সামরিক শক্তির সমর্থনে তিনি তাঁর ভাবধারা জোরপূর্বক প্রয়োগ করতে পারেন, যেমন বিদআতি প্রথা ধ্বংস করা এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।স্থানীয় নেতাদের সমর্থন: তিনি স্থানীয় গোত্রীয় নেতাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাঁদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সমর্থন লাভ করেন।

তথ্যসূত্র:David Commins, The Wahhabi Mission and Saudi Arabia (2006):

 আবদুল ওয়াহাবের নেতৃত্বের কৌশল ও প্রভাব।সারসংক্ষেপমুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব ছিলেন একজন ধর্মীয় সংস্কারক, যিনি তৌহিদের উপর জোর দিয়ে ওয়াহাবি ভাবধারা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মুসলমানদের নেতৃত্ব দিতে পারেন তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা, আল-সৌদ পরিবারের সাথে জোট, নাজদের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং স্থানীয় নেতাদের সমর্থনের মাধ্যমে। তাঁর ভাবধারা আল-সৌদের রাজনৈতিক শক্তির সাথে মিলিত হয়ে প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করে, যা পরবর্তীতে আধুনিক সৌদি আরবের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...