সৌদ পরিবার ও ওয়াহাবিদের ক্ষমতা লাভের পূর্বে আরব বিশ্বে সুফিবাদ

আরব জগতে সৌদি রাজপরিবারের উত্থানের পূর্বে, অর্থাৎ ১৮শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে (মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব ও আল-সৌদ পরিবারের জোটের আগে, ১৭৪৪ সালের পূর্বে), মুসলিম সমাজে পীর, খানকা, মাজার এবং সুফি ভাবাদর্শ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। আরব উপদ্বীপ, বিশেষ করে হিজাজ (মক্কা ও মদিনা অঞ্চল), নাজদ, এবং আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে সুফি প্রথা ও সংস্কৃতি ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। 

নিচে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা তথ্যসূত্রসহ দেওয়া হলো।

১. আরব জগতে সুফি ভাবাদর্শের প্রচলনসুফি ভাবাদর্শ, যা ইসলামের রহস্যবাদী দিকের উপর জোর দেয়, আরব জগতে ৮ম শতাব্দী থেকেই বিস্তার লাভ করেছিল। সুফিবাদ মূলত আধ্যাত্মিকতা, ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ এবং ভক্তিমূলক অনুশীলনের উপর গুরুত্ব দেয়। আরব উপদ্বীপে, বিশেষ করে হিজাজ এবং ইয়েমেনে, সুফি তরিকাগুলো (যেমন কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া, শাযিলিয়া) জনপ্রিয় ছিল। এই ভাবাদর্শ মুসলিম সমাজের বিভিন্ন স্তরে, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে, গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

পীর ও শাইখ: সুফি পীর বা শাইখরা ধর্মীয় নেতা হিসেবে বিবেচিত হতেন, যারা তাদের অনুসারীদের আধ্যাত্মিক পথে পরিচালনা করতেন। তারা আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রদান করতেন এবং প্রায়শই তাদের অনুগতদের মধ্যে একটি আনুগত্যের সম্পর্ক গড়ে উঠত।

খানকা: খানকা ছিল সুফি শিক্ষা ও ধ্যানের কেন্দ্র, যেখানে সুফি শিষ্যরা জিকির (আল্লাহর নাম স্মরণ), ধ্যান এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষায় অংশ নিত। হিজাজ এবং ইয়েমেনে এই ধরনের খানকাগুলো সাধারণ ছিল।

মাজার: সুফি সাধক বা পীরদের সমাধি (মাজার) পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হত। মুসলমানরা এই মাজারে দোয়া, তওয়াসসুল (মধ্যস্থতার মাধ্যমে প্রার্থনা) এবং আধ্যাত্মিক আশীর্বাদের জন্য যেতেন। মক্কা ও মদিনার আশেপাশে এবং ইয়েমেনে এই ধরনের মাজারগুলো জনপ্রিয় ছিল।

তথ্যসূত্র:Carl W. Ernst, The Shambhala Guide to Sufism (1997): সুফিবাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং আরব জগতে এর বিস্তার।Annemarie Schimmel, Mystical Dimensions of Islam (1975): সুফি ভাবাদর্শ ও তরিকার ইতিহাস।John Spencer Trimingham, The Sufi Orders in Islam (1998): আরব উপদ্বীপে সুফি তরিকার বিস্তার।

২. হিজাজ অঞ্চলে সুফি প্রভাবহিজাজ, যেখানে মক্কা ও মদিনা অবস্থিত, ইসলামের পবিত্র কেন্দ্র হিসেবে সুফি ভাবাদর্শের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই অঞ্চল ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল (১৬শ থেকে ১৯শ শতাব্দী), এবং ওসমানীয় শাসন সুফি তরিকাগুলোকে সমর্থন করত।

সুফি তরিকা: হিজাজে কাদিরিয়া এবং শাযিলিয়া তরিকা বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল। এই তরিকাগুলোর শাইখরা মক্কা ও মদিনায় ধর্মীয় শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন পরিচালনা করতেন।

মাজার ও পবিত্র স্থান: মদিনায় জান্নাতুল বাকি এবং মক্কার আশেপাশে বিভিন্ন সুফি সাধক ও প্রাথমিক মুসলিম ব্যক্তিত্বদের মাজার ছিল। এই মাজারগুলোতে হজযাত্রীরা প্রায়শই জিয়ারত করতেন।হজের ভূমিকা: হজের সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানরা হিজাজে সমবেত হতেন, এবং সুফি শাইখরা এই সুযোগে তাদের শিক্ষা প্রচার করতেন। এটি সুফি ভাবাদর্শের বিস্তারে সহায়ক ছিল।

তথ্যসূত্র:Michael Wolfe, One Thousand Roads to Mecca (1997): হজের ইতিহাস ও সুফি প্রভাব।Samer Akkach, Letters of a Sufi Scholar: The Correspondence of ‘Abd al-Ghani al-Nabulsi (2010): হিজাজে সুফি শিক্ষা ও প্রভাব।

৩. নাজদ অঞ্চলে সুফি প্রভাবনাজদ, যেখানে ওয়াহাবি আন্দোলনের উৎপত্তি হয়, তুলনামূলকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং বেদুঈন-অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল। তবে, এখানেও সুফি ভাবাদর্শের উপস্থিতি ছিল, যদিও হিজাজের তুলনায় কম।

স্থানীয় প্রথা: নাজদে সুফি তরিকাগুলোর প্রভাব সীমিত ছিল, কিন্তু স্থানীয় গোত্রীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু আধ্যাত্মিক প্রথা প্রচলিত ছিল, যেমন পীরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং পবিত্র স্থানে দোয়া। এই প্রথাগুলো প্রায়শই স্থানীয় ঐতিহ্যের সাথে মিশ্রিত ছিল।

ওয়াহাবি সমালোচনা: মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব এই অঞ্চলে প্রচলিত কিছু প্রথা, যেমন মাজার জিয়ারত এবং সুফি আচার-অনুষ্ঠান, শিরক (বহুখোদাবাদ) হিসেবে সমালোচনা করেন। এটি প্রমাণ করে যে নাজদে সুফি প্রভাব কিছুটা হলেও বিদ্যমান ছিল।

তথ্যসূত্র:David Commins, The Wahhabi Mission and Saudi Arabia (2006): নাজদে সুফি প্রথা ও ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট।Natana J. DeLong-Bas, Wahhabi Islam: From Revival and Reform to Global Jihad (2004): নাজদের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট।

৪. ইয়েমেন ও অন্যান্য আরব অঞ্চলে সুফি প্রভাবইয়েমেনে সুফি ভাবাদর্শ বিশেষভাবে শক্তিশালী ছিল। এই অঞ্চলে শাযিলিয়া এবং বাকিলিয়া তরিকা জনপ্রিয় ছিল। ইয়েমেনের হাদরামাউত অঞ্চল সুফি পণ্ডিত ও সাধকদের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।খানকা ও মাজার: ইয়েমেনে সুফি শাইখদের খানকা এবং মাজারগুলো ধর্মীয় ও সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। উদাহরণস্বরূপ, শাইখ আহমদ ইবনে আলওয়ানের মতো সুফি সাধকদের মাজার জনপ্রিয় ছিল।

সুফি শিক্ষা: ইয়েমেনের সুফি পণ্ডিতরা ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করেছিল। হাদরামাউতের সুফি শাইখরা ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রেখেছিলেন।

তথ্যসূত্র:Alexander Knysh, Ibn ‘Arabi in the Later Islamic Tradition (1999): ইয়েমেনে সুফি ভাবাদর্শের প্রভাব।Engseng Ho, The Graves of Tarim: Genealogy and Mobility across the Indian Ocean (2006): হাদরামাউতের সুফি ঐতিহ্য।

৫. ওসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রভাব১৮শ শতাব্দী পর্যন্ত আরব উপদ্বীপের বেশিরভাগ অঞ্চল ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। ওসমানীয়রা সুফি তরিকাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করত এবং সুফি শাইখদের সম্মান করত।সুফি তরিকার সমর্থন: ওসমানীয় সুলতানরা নকশবন্দিয়া, কাদিরিয়া এবং মেভলেভি তরিকার প্রতি সমর্থন প্রদান করত। এই তরিকাগুলো হিজাজে তাদের প্রভাব বিস্তার করেছিল।
মাজার ও জিয়ারত: ওসমানীয়রা মক্কা ও মদিনার মাজারগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণে অর্থ ব্যয় করত। উদাহরণস্বরূপ, জান্নাতুল বাকির সমাধিগুলো ওসমানীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রক্ষিত হত।

তথ্যসূত্র:Suraiya Faroqhi, The Ottoman Empire and the World Around It (2004): ওসমানীয় সাম্রাজ্যে সুফি তরিকার ভূমিকা।Francis Robinson, The Cambridge Illustrated History of the Islamic World (1996): ওসমানীয় শাসনে সুফি প্রভাব।

৬. সুফি ভাবাদর্শের বিরোধিতা ও ওয়াহাবি আন্দোলনমুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের উত্থানের পূর্বে আরব উপদ্বীপে সুফি ভাবাদর্শ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। তবে, তিনি এই প্রথাগুলোকে শিরক ও বিদআত হিসেবে সমালোচনা করেন। ১৭৪৪ সালে আল-সৌদ পরিবারের সাথে তার জোটের মাধ্যমে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু হয়, যা সুফি প্রথা, মাজার জিয়ারত এবং খানকার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। এই আন্দোলন সুফি ভাবাদর্শের প্রভাব হ্রাসে ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে নাজদে এবং পরবর্তীতে প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের অধীনে।

তথ্যসূত্র:David Commins, The Wahhabi Mission and Saudi Arabia (2006): ওয়াহাবি আন্দোলনের সুফি বিরোধিতা।Madawi Al-Rasheed, A History of Saudi Arabia (2002): 

ওয়াহাবি আন্দোলনের উত্থান ও সুফি প্রথার উপর প্রভাব।সারসংক্ষেপ 
সৌদি রাজপরিবারের উত্থানের পূর্বে (১৭৪৪ সালের আগে) আরব জগতে সুফি ভাবাদর্শ, পীর, খানকা এবং মাজার ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। হিজাজে মক্কা ও মদিনার আধ্যাত্মিক পরিবেশ, ইয়েমেনের হাদরামাউতের সুফি কেন্দ্র এবং ওসমানীয় শাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় এই প্রথাগুলো সমৃদ্ধ হয়েছিল। নাজদে সুফি প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম ছিল, তবে স্থানীয় আধ্যাত্মিক প্রথা বিদ্যমান ছিল। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের ওয়াহাবি আন্দোলন এই প্রথাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে সুফি ভাবাদর্শের প্রভাব হ্রাসে ভূমিকা রাখে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...