ইসলামে চারটি বিবাহ করা কখন জায়েজ

ইসলামে পুরুষদের চারটি বিবাহের বিধান কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রতিষ্ঠিত। তবে, এই বিধানের সাথে কিছু শর্ত, দায়িত্ব এবং পরিস্থিতি জড়িত, যা পালন করা বাধ্যতামূলক। নিচে এই বিষয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা হলো, তথ্যসহ:

### **ইসলামে চারটি বিবাহের বিধান**
1. **কুরআনের ভিত্তি**: 
   - পবিত্র কুরআনের সূরা নিসা (৪:৩) এ বলা হয়েছে:  
     *“যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, ইয়াতিমদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারবে না, তবে তোমরা যাকে পছন্দ কর, তাদের মধ্যে থেকে দুই, তিন অথবা চারটি পর্যন্ত বিবাহ কর। কিন্তু যদি আশঙ্কা কর যে, ন্যায়বিচার করতে পারবে না, তবে কেবল একটি বিবাহ কর অথবা তোমাদের ডান হাত যাদের মালিক তাদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাক। এতে পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা কম হবে।”*  
     এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, একজন পুরুষ সর্বোচ্চ চারটি বিবাহ করতে পারেন, তবে এর জন্য কঠিন শর্ত রয়েছে।

2. **হাদিসের সমর্থন**: 
   - রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে একাধিক বিবাহ করেছিলেন, তবে তাঁর বিবাহগুলো সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক কারণে ছিল। তিনি স্ত্রীদের প্রতি সমান ন্যায়বিচার করতেন (সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ২৬৮)।
   - হাদিসে বলা হয়েছে, ন্যায়বিচার না করতে পারলে একাধিক বিবাহ থেকে বিরত থাকতে (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ১৪৬৮)।

### **চারটি বিবাহের শর্ত ও পরিস্থিতি**
ইসলামে একাধিক বিবাহের অনুমতি শর্তসাপেক্ষে দেওয়া হয়েছে। এই শর্তগুলো পূরণ না হলে একাধিক বিবাহ করা নিষিদ্ধ বা অবৈধ হতে পারে। নিচে শর্তগুলো এবং কখন বিবাহ করা যাবে বা যাবে না তা তুলনামূলকভাবে আলোচনা করা হলো:

#### **কখন একাধিক বিবাহ করা যাবে**
1. **ন্যায়বিচারের সামর্থ্য**:
   - স্ত্রীদের মধ্যে সমান ন্যায়বিচার করতে হবে, যেমন: সময়, ভরণপোষণ, বাসস্থান, এবং মানসিক ও শারীরিক সমর্থন। কুরআনে বলা হয়েছে, ন্যায়বিচার না করতে পারলে একটিই যথেষ্ট।
   - উদাহরণ: যদি কোনো পুরুষ আর্থিকভাবে সচ্ছল হয় এবং প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য সমান ব্যয় করতে পারে, তবে সে একাধিক বিবাহ করতে পারে।

2. **সামাজিক ও পারিবারিক প্রয়োজন**:
   - ইয়াতিম বা বিধবাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বিবাহ করা যেতে পারে, যেমনটি সূরা নিসার আয়াতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
   - উদাহরণ: যুদ্ধ বা দুর্যোগের পর বিধবা নারীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য একাধিক বিবাহের প্রয়োজন হতে পারে।

3. **প্রথম স্ত্রীর সম্মতি (নৈতিক দৃষ্টিকোণ)**:
   - যদিও শরিয়াহতে প্রথম স্ত্রীর সম্মতি বাধ্যতামূলক নয়, তবে অনেক আলেম পরামর্শ দেন যে, স্ত্রীর সম্মতি নেওয়া উত্তম। এটি পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখে।

4. **শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য**:
   - একাধিক স্ত্রীর ভরণপোষণ, আবাসন এবং অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর আর্থিক সামর্থ্য থাকতে হবে।
   - শারীরিকভাবে স্ত্রীদের প্রতি সমান দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা থাকতে হবে।

#### **কখন একাধিক বিবাহ করা যাবে না**
1. **ন্যায়বিচারের অক্ষমতা**:
   - যদি কোনো পুরুষ স্ত্রীদের মধ্যে সমান ন্যায়বিচার করতে না পারে, তবে একাধিক বিবাহ করা তার জন্য হারাম। কুরআনে বলা হয়েছে: *“তোমরা কখনোই সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করতে পারবে না, যদিও তা কামনা কর”* (সূরা নিসা, ৪:১২৯)। তবে এখানে আর্থিক ও শারীরিক ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে, ভালোবাসার ক্ষেত্রে মানুষের হৃদয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই।
   - উদাহরণ: যদি কেউ এক স্ত্রীকে বেশি সময় বা সুবিধা দেয় এবং অন্যজনকে অবহেলা করে, তবে এটি নিষিদ্ধ।

2. **আর্থিক অক্ষমতা**:
   - যদি কোনো পুরুষ স্ত্রীদের ভরণপোষণ বা অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম হয়, তবে একাধিক বিবাহ করা তার জন্য অনুচিত।
   - উদাহরণ: যদি কারও আয় শুধু একটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট হয়, তবে দ্বিতীয় বিবাহ করা তার জন্য বৈধ নয়।

3. **প্রথম স্ত্রীর সাথে চুক্তি**:
   - যদি বিবাহের চুক্তিতে প্রথম স্ত্রী শর্ত দেয় যে স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করবে না, এবং স্বামী তা মেনে নেয়, তবে সে দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারবে না। এটি শরিয়াহ সম্মত চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।

4. **সামাজিক অস্থিরতা**:
   - যদি একাধিক বিবাহ পরিবার বা সমাজে অশান্তি বা অস্থিরতা সৃষ্টি করে, তবে তা থেকে বিরত থাকা উচিত। ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতিকে প্রাধান্য দেয়।

5. **অনৈতিক উদ্দেশ্য**:
   - যদি বিবাহের উদ্দেশ্য কেবল কামনা-বাসনা পূরণ বা অনৈতিক কারণ হয়, তবে তা নিষিদ্ধ। বিবাহের উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালন।

### **তুলনামূলক বিশ্লেষণ**
| **বিষয়** | **বিবাহ করা যাবে** | **বিবাহ করা যাবে না** |
|-----------|---------------------|-------------------------|
| **ন্যায়বিচার** | স্ত্রীদের মধ্যে সমান ন্যায়বিচার করতে পারলে | ন্যায়বিচার করতে অক্ষম হলে |
| **আর্থিক সামর্থ্য** | সকল স্ত্রীর ভরণপোষণের সামর্থ্য থাকলে | আর্থিক অক্ষমতা থাকলে |
| **সামাজিক প্রয়োজন** | ইয়াতিম বা বিধবার সুরক্ষার জন্য | কোনো বৈধ কারণ না থাকলে |
| **চুক্তি** | প্রথম স্ত্রীর সম্মতি থাকলে বা চুক্তি না থাকলে | চুক্তি লঙ্ঘন করলে |
| **উদ্দেশ্য** | আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পারিবারিক দায়িত্বের জন্য | কেবল কামনা-বাসনার জন্য |

### **আধুনিক প্রেক্ষাপটে বিবাহের বিধান**
- আধুনিক সমাজে একাধিক বিবাহ অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক ও আইনি জটিলতা সৃষ্টি করে। অনেক মুসলিম দেশে (যেমন: তুরস্ক, তিউনিসিয়া) একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ বা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।
- বাংলাদেশের মতো দেশে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ (১৯৬১) অনুসারে, দ্বিতীয় বিবাহের জন্য প্রথম স্ত্রীর সম্মতি এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রয়োজন।

### **উপসংহার**
ইসলামে চারটি বিবাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে কঠিন শর্তসাপেক্ষে, যেমন ন্যায়বিচার, আর্থিক সামর্থ্য এবং সামাজিক প্রয়োজনীয়তা। এটি কোনো বাধ্যতামূলক বিধান নয়, বরং একটি অনুমতি যা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। যদি কেউ এই শর্ত পূরণ করতে না পারে, তবে একটি বিবাহই উত্তম। আধুনিক প্রেক্ষাপটে সামাজিক ও আইনি বিষয়গুলোও বিবেচনা করা জরুরি।

**তথ্যসূত্র**:
- পবিত্র কুরআন, সূরা নিসা (৪:৩, ৪:১২৯)
- সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ২৬৮
- সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ১৪৬৮
- মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ (বাংলাদেশ)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...