সৌদি রাজপরিবারের ইতিহাস ও ওয়াহাব পরিবারের কতৃত্ব

বর্তমান সৌদি রাজবংশের ইতিহাস
  
বর্তমান সৌদি রাজবংশ, যা আল-সৌদ পরিবার নামে পরিচিত, সৌদি আরবের শাসক পরিবার। এই রাজবংশের ইতিহাস তিনটি প্রধান পর্যায়ে বিভক্ত: প্রথম সৌদি রাষ্ট্র (১৭৪৪-১৮১৮), দ্বিতীয় সৌদি রাষ্ট্র (১৮২৪-১৮৯১), এবং বর্তমান তৃতীয় সৌদি রাষ্ট্র (১৯০২-বর্তমান)। আধুনিক সৌদি আরব ১৯৩২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ হিজাজ, নাজদ এবং অন্যান্য অঞ্চল একীভূত করে রাজ্যটি গঠন করেন।ইতিহাসের প্রধান পর্যায়প্রথম সৌদি রাষ্ট্র (১৭৪৪-১৮১৮):১৭৪৪ সালে মুহাম্মদ ইবনে সৌদ, দিরিয়ার শাসক, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের সাথে একটি ধর্মীয়-রাজনৈতিক জোট গঠন করেন। এই জোটে ওয়াহাবি ভাবধারা রাষ্ট্রের ধর্মীয় ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়, এবং আল-সৌদ পরিবার রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব দেয়।এই রাষ্ট্র নাজদ থেকে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অংশে প্রভাব বিস্তার করে, কিন্তু ১৮১৮ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মিশরীয় বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়।

তথ্যসূত্র:Madawi Al-Rasheed, A History of Saudi Arabia (2002): প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের ইতিহাস।David Commins, The Wahhabi Mission and Saudi Arabia (2006): ওয়াহাবি-আল-সৌদ জোটের প্রেক্ষাপট।

দ্বিতীয় সৌদি রাষ্ট্র (১৮২৪-১৮৯১):তুর্কি ইবনে আবদুল্লাহ আল-সৌদ ১৮২৪ সালে রিয়াদ কেন্দ্র করে দ্বিতীয় সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাষ্ট্র নাজদে কিছুটা প্রভাব ফিরিয়ে আনে, কিন্তু আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং আল-রশিদ পরিবারের সাথে প্রতিযোগিতার কারণে ১৮৯১ সালে পতন ঘটে।এই সময়ে ওয়াহাবি ভাবধারা রাষ্ট্রের ধর্মীয় ভিত্তি হিসেবে অব্যাহত থাকে।তথ্যসূত্র:Alexei Vassiliev, The History of Saudi Arabia (1998): দ্বিতীয় সৌদি রাষ্ট্রের উত্থান ও পতন।

তৃতীয় সৌদি রাষ্ট্র (১৯০২-বর্তমান):১৯০২ সালে আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ রিয়াদ পুনরুদ্ধার করে তৃতীয় সৌদি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি ইখওয়ান নামে একটি বেদুঈন সামরিক বাহিনীর সমর্থনে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করেন, যার মধ্যে ১৯২৫ সালে হিজাজ এবং ১৯৩২ সালে সৌদি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।১৯৫৩ সালে আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর তার পুত্ররা ধারাবাহিকভাবে রাজা হন। বর্তমানে (২০২৫ সাল পর্যন্ত) রাজা সালমান ইবনে আবদুল আজিজ এবং ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান দেশ পরিচালনা করছেন।ভিশন ২০৩০ এর মাধ্যমে সৌদি আরব অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ এবং ধর্মীয় সংস্কারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যদিও ওয়াহাবি ভাবধারা এখনও রাষ্ট্রের ধর্মীয় ভিত্তি।

তথ্যসূত্র:Madawi Al-Rasheed, A History of Saudi Arabia (2002): তৃতীয় সৌদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ।BBC News, “Saudi Arabia’s Vision 2030: Reining in Wahhabism?” (2020): 

বর্তমান সৌদি সংস্কার।মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের সাথে চুক্তি১৭৪৪ সালে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব, একজন ধর্মীয় পণ্ডিত যিনি ইসলামের কঠোর, পিউরিটানিক্যাল ব্যাখ্যা প্রচার করেন, দিরিয়ার শাসক মুহাম্মদ ইবনে সৌদের সাথে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি করেন। এই চুক্তি ছিল সৌদি রাজবংশের উত্থানের ভিত্তি।

চুক্তির বিবরণ:ওয়াহাব ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রদান করেন, তৌহিদ (একত্ববাদ) এবং শিরক (বহুখোদাবাদ) ও বিদআত (ধর্মীয় উদ্ভাবন) বিরোধী প্রচারণার উপর জোর দেন।ইবনে সৌদ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব প্রদান করেন, ওয়াহাবি ভাবধারাকে রাষ্ট্রের ধর্মীয় ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন।এই জোট আরব উপদ্বীপে আল-সৌদের প্রভাব বিস্তারে সহায়ক হয় এবং প্রথম সৌদি রাষ্ট্র গঠন করে।
প্রভাব:এই চুক্তি ওয়াহাবি ভাবধারাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে, যা পরবর্তীতে আধুনিক সৌদি আরবের ধর্মীয় ভিত্তি হয়।ওয়াহাবি আন্দোলন সুফি প্রথা, মাজার জিয়ারত এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক অনুশীলনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়, যা আরব উপদ্বীপের ধর্মীয় ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তন করে।

তথ্যসূত্র:Natana J. DeLong-Bas, Wahhabi Islam: From Revival and Reform to Global Jihad (2004): 
ওয়াহাব-আল-সৌদ চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ।David Commins, The Wahhabi Mission and Saudi Arabia (2006): 

চুক্তির ঐতিহাসিক তাৎপর্য।ক্ষমতা লাভের ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের অবদানপশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি রাজবংশের ক্ষমতা লাভে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, মূলত ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে। তবে, তাদের সমর্থন সরাসরি ওয়াহাবি ভাবধারার প্রচারের উদ্দেশ্যে ছিল না।
১. ব্রিটিশ সমর্থন (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ):প্রেক্ষাপট: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) ব্রিটেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহকে সমর্থন করে। আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ, যিনি তৃতীয় সৌদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, ব্রিটিশদের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পান।Treaty of Darin (১৯১৫):
 এই চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেন আল-সৌদকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। এই সমর্থন আবদুল আজিজকে নাজদ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করে।প্রভাব: ব্রিটিশ সমর্থন আল-সৌদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে, যা তাদের হিজাজ দখল (১৯২৫) এবং সৌদি আরব প্রতিষ্ঠায় (১৯৩২) সহায়ক হয়।

তথ্যসূত্র:Eugene Rogan, The Arabs: A History (2009): আরব বিদ্রোহে ব্রিটিশ ভূমিকা।Madawi Al-Rasheed, A History of Saudi Arabia (2002): ব্রিটিশ সমর্থন ও আল-সৌদের উত্থান।

২. তেল আবিষ্কার ও আমেরিকান সমর্থন:তেল শিল্প (১৯৩০-এর দশক): ১৯৩৮ সালে সৌদি আরবে তেল আবিষ্কারের পর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক গভীর হয়। ১৯৩৩ সালে Standard Oil of California (পরবর্তীতে Aramco) সৌদি আরবের সাথে তেল অনুসন্ধানের চুক্তি করে। এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক সৌদি রাজপরিবারকে প্রচুর সম্পদ প্রদান করে, যা তারা রাষ্ট্র পরিচালনা ও ওয়াহাবি ভাবধারা প্রচারে ব্যবহার করে।রাজনৈতিক সমর্থন: ১৯৪৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট এবং আবদুল আজিজের মধ্যে কুইন্সি জাহাজে বৈঠক হয়, যা তেল সরবরাহের বিনিময়ে সৌদি আরবের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। এই সম্পর্ক সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়ক হয়।

তথ্যসূত্র:Daniel Yergin, The Prize: The Epic Quest for Oil, Money & Power (1991): তেল শিল্পে আমেরিকার ভূমিকা।Robert Vitalis, America’s Kingdom: Mythmaking on the Saudi Oil Frontier (2006): সৌদি-আমেরিকান অর্থনৈতিক সম্পর্ক।৩. শীতল যুদ্ধে কৌশলগত জোট:শীতল যুদ্ধের সময় (১৯৪৫-১৯৯১) যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে সোভিয়েত প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। এই সমর্থন সৌদি রাজপরিবারের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।আফগান জিহাদ (১৯৮০-এর দশক): সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্র একত্রে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিরোধী মুজাহিদিনদের সমর্থন করে। সৌদি আরব এই সময়ে তেলের আয় ব্যবহার করে ধর্মীয় প্রচারণায় অর্থায়ন করে, যা ওয়াহাবি ভাবধারার বিস্তারে সহায়ক হয়। যদিও এটি পশ্চিমা বিশ্বের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল না, তাদের সমর্থন সৌদি ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।তথ্যসূত্র:Rachel Bronson, Thicker Than Oil: America’s Uneasy Partnership with Saudi Arabia (2006): শীতল যুদ্ধে সৌদি-আমেরিকান সম্পর্ক।Steve Coll, Ghost Wars: The Secret History of the CIA, Afghanistan, and Bin Laden (2004): আফগান জিহাদে পশ্চিমা ও সৌদি ভূমিকা।

৪. বর্তমান প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা সমর্থন (২০২৫ পর্যন্ত):পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবের সাথে অস্ত্র চুক্তি এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ প্রকল্পে পশ্চিমা বিনিয়োগ রয়েছে।তবে, পশ্চিমা বিশ্ব সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ধর্মীয় প্রচারণার সমালোচনা করে, যদিও তেল ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে সম্পর্ক অব্যাহত রয়েছে।

তথ্যসূত্র:Reuters, “U.S.-Saudi Arms Deals Continue Despite Criticism” (2023): বর্তমান পশ্চিমা-সৌদি সম্পর্ক।The Guardian, “Saudi Arabia and the West: A Special Relationship?” (2022): পশ্চিমা সমর্থনের বর্তমান প্রেক্ষাপট

।সারসংক্ষেপ  সৌদি রাজবংশের ইতিহাস: আল-সৌদ পরিবার তিনটি পর্যায়ে আরব উপদ্বীপে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে, যার মধ্যে তৃতীয় সৌদি রাষ্ট্র (১৯০২-বর্তমান) আধুনিক সৌদি আরবের ভিত্তি। এই রাষ্ট্র ১৯৩২ সালে আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়।আবদুল ওয়াহাবের সাথে চুক্তি: 
১৭৪৪ সালে মুহাম্মদ ইবনে সৌদের সাথে ওয়াহাবের চুক্তি সৌদি রাজবংশের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করে, যা ওয়াহাবি ভাবধারাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

পশ্চিমা বিশ্বের অবদান: ব্রিটিশ সমর্থন (১৯১৫-এর Treaty of Darin), আমেরিকান তেল শিল্পের সহযোগিতা, এবং শীতল যুদ্ধের কৌশলগত জোট সৌদি রাজবংশের ক্ষমতা ও সম্পদ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। এই সমর্থন পরোক্ষভাবে ওয়াহাবি ভাবধারার প্রসারে অবদান রাখে, যদিও এটি পশ্চিমা বিশ্বের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল না।
বর্তমান সৌদি রাজবংশ (আল-সৌদ পরিবার) এবং মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের ভাবাদর্শের উত্তরাধিকার আরব বিশ্বে ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে একটি জটিল এবং বহুমুখী কাঠামোর মাধ্যমে কাজ করে। সৌদি রাজবংশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে, যখন আবদুল ওয়াহাবের পরিবার এবং তাদের ওয়াহাবি ভাবাদর্শ ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। তবে, আবদুল ওয়াহাবের বংশধরদের (যারা আল-শেখ পরিবার নামে পরিচিত) প্রভাব মূলত ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, এবং তারা সরাসরি রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে না। নিচে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা তথ্যসূত্রসহ দেওয়া হলো।

১. সৌদি রাজবংশের (আল-সৌদ) ক্ষমতা ধরে রাখার পদ্ধতি  সৌদি রাজবংশ আরব বিশ্বে, বিশেষ করে সৌদি আরবে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার প্রধান কৌশলগুলো নিম্নরূপ:
১.১. রাজনৈতিক কাঠামো ও শাসনব্যবস্থাএকনায়কতান্ত্রিক রাজতন্ত্র: সৌদি আরব একটি পরম রাজতন্ত্র, যেখানে আল-সৌদ পরিবারের রাজা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। বর্তমান রাজা সালমান ইবনে আবদুল আজিজ (২০১৫-বর্তমান) এবং ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণ করেন। রাজপরিবারের সদস্যরা প্রধান মন্ত্রণালয়, প্রাদেশিক গভর্নর পদ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত থাকেন।ধর্মীয় বৈধতা: আল-সৌদ পরিবার ১৭৪৪ সালে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের সাথে চুক্তির মাধ্যমে ওয়াহাবি ভাবধারাকে রাষ্ট্রের ধর্মীয় ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। এই ভাবধারা তাদের শাসনকে ধর্মীয় বৈধতা প্রদান করে, যা জনগণের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়।

ভিশন ২০৩০ এবং সংস্কার: মুহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে ভিশন ২০৩০ প্রকল্পের মাধ্যমে সৌদি আরব তেল-নির্ভর অর্থনীতি থেকে বৈচিত্র্যকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার (যেমন নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি, বিনোদন শিল্পের প্রসার) জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে সহায়ক হয়েছে। তবে, এই সংস্কারগুলো কঠোর ওয়াহাবি নীতির কিছু দিক হ্রাস করলেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর রাজপরিবারের নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

তথ্যসূত্র:Madawi Al-Rasheed, A History of Saudi Arabia (2002): আল-সৌদের শাসনব্যবস্থা ও ধর্মীয় বৈধতা।BBC News, “Saudi Arabia’s Vision 2030: Reining in Wahhabism?” (2020): বর্তমান সৌদি সংস্কার ও ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল।

১.২. অর্থনৈতিক শক্তিতেলের সম্পদ: সৌদি আরব বিশ্বের বৃহত্তম তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর একটি। তেলের আয় রাজপরিবারকে বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি প্রদান করে, যা তারা জনকল্যাণমূলক প্রকল্প, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ধর্মীয় প্রচারণায় ব্যবহার করে। এই সম্পদ জনগণের মধ্যে আনুগত্য বজায় রাখতে সহায়ক।বৈশ্বিক বিনিয়োগ: সৌদি আরবের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল (Public Investment Fund) এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করে। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরব পশ্চিমা কোম্পানি এবং প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, যা তাদের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ায়।

তথ্যসূত্র:Daniel Yergin, The Prize: The Epic Quest for Oil, Money & Power (1991): তেল অর্থনীতির ভূমিকা।Reuters, “Saudi Arabia’s Public Investment Fund: A Global Player” (2023): সৌদি বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক শক্তি।১.৩. সামরিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাসামরিক শক্তি: সৌদি আরব পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য, থেকে উন্নত অস্ত্র ক্রয় করে। এই সামরিক শক্তি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক হুমকি মোকাবিলায় ব্যবহৃত হয়।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা: সৌদি রাজপরিবার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সম্ভাব্য বিরোধীদের দমন করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালে মুহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে বেশ কয়েকজন রাজপরিবারের সদস্য এবং ব্যবসায়ী নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়, যা ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণে সহায়ক হয়।

তথ্যসূত্র:Reuters, “U.S.-Saudi Arms Deals Continue Despite Criticism” (2023): সৌদি সামরিক শক্তি ও পশ্চিমা সমর্থন।The Guardian, “Saudi Arabia’s Crackdown: Consolidating Power” (2017): অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ।

২. আবদুল ওয়াহাবের পরিবারের (আল-শেখ) ক্ষমতা ও প্রভাবমুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের বংশধররা, যারা আল-শেখ পরিবার নামে পরিচিত, সৌদি আরবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, তাদের ক্ষমতা রাজনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।

২.১. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রভাবহাইয়াত কিবার আল-উলামা (Council of Senior Scholars): আল-শেখ পরিবারের সদস্যরা সৌদি আরবের শীর্ষ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, গ্র্যান্ড মুফতি আবদুল আজিজ আল-শেখ এই পরিবারের একজন সদস্য। এই প্রতিষ্ঠান ফতোয়া জারি করে এবং ধর্মীয় নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।ধর্মীয় শিক্ষা: আল-শেখ পরিবার মদিনার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাব বজায় রাখে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়াহাবি ভাবধারা প্রচারে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।মসজিদ ও মাদ্রাসা: আল-শেখ পরিবারের সদস্যরা সৌদি আরবের মসজিদ ও মাদ্রাসার ধর্মীয় নেতৃত্বে জড়িত। তারা ওয়াহাবি ভাবধারার কঠোর ব্যাখ্যা প্রচার করে, যা সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে প্রভাব ফেলে।
তথ্যসূত্র:David Commins, The Wahhabi Mission and Saudi Arabia (2006): আল-শেখ পরিবারের ধর্মীয় ভূমিকা।Natana J. DeLong-Bas, Wahhabi Islam: From Revival and Reform to Global Jihad (2004): ওয়াহাবি ভাবধারার ধর্মীয় প্রভাব।২.২. রাজনৈতিক প্রভাবের সীমাবদ্ধতাআল-শেখ পরিবার সরাসরি রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে না। তাদের প্রভাব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ, এবং তারা আল-সৌদ পরিবারের অধীনে কাজ করে। রাজপরিবার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে, এবং আল-শেখ পরিবার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না।বর্তমানে মুহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কারের ফলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রভাব কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ধর্মীয় পুলিশের (হাইয়া) ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছে, যা আল-শেখ পরিবারের প্রভাবকে সীমিত করেছে।

তথ্যসূত্র:Foreign Policy, “The Saudi Religious Establishment Under Pressure” (2018): আল-শেখ পরিবারের সীমিত প্রভাব।Guido Steinberg, Religion and State in Saudi Arabia (2006): ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক।

৩. পশ্চিমা বিশ্বের অবদানপশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি রাজবংশের ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং ওয়াহাবি ভাবধারার প্রসারে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে, এই সমর্থন মূলত ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত।

৩.১. ব্রিটিশ সমর্থন (১৯শ শতাব্দী ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ):প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) ব্রিটেন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহকে সমর্থন করে। আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ ১৯১৫ সালের Treaty of Darin-এর মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পান। এই সমর্থন তাকে নাজদ এবং হিজাজ দখলে সহায়তা করে।ব্রিটিশ সমর্থন আল-সৌদ পরিবারকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হয়, যা তাদের ওয়াহাবি ভাবধারা প্রচারে শক্তি যোগায়।

তথ্যসূত্র:Eugene Rogan, The Arabs: A History (2009): আরব বিদ্রোহে ব্রিটিশ ভূমিকা।Madawi Al-Rasheed, A History of Saudi Arabia (2002): ব্রিটিশ সমর্থন ও আল-সৌদের উত্থান।

৩.২. তেল ও আমেরিকান সমর্থন:তেল আবিষ্কার (১৯৩৮): ১৯৩৩ সালে Standard Oil of California (Aramco) সৌদি আরবে তেল অনুসন্ধান শুরু করে। তেলের আয় আল-সৌদ পরিবারকে অর্থনৈতিক শক্তি প্রদান করে, যা তারা রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ওয়াহাবি ভাবধারা প্রচারে ব্যবহার করে।
কুইন্সি চুক্তি (১৯৪৫): যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট এবং আবদুল আজিজের মধ্যে এই চুক্তি তেল সরবরাহের বিনিময়ে সৌদি আরবের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। এই সম্পর্ক আল-সৌদের ক্ষমতা ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ধর্মীয় প্রচারণায় পরোক্ষ প্রভাব: তেলের আয় ব্যবহার করে সৌদি আরব বিশ্বব্যাপী মাদ্রাসা, মসজিদ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করে, যা আল-শেখ পরিবারের ওয়াহাবি ভাবধারার প্রসারে সহায়ক হয়।

তথ্যসূত্র:Robert Vitalis, America’s Kingdom: Mythmaking on the Saudi Oil Frontier (2006): তেল শিল্পে আমেরিকার ভূমিকা।Rachel Bronson, Thicker Than Oil: America’s Uneasy Partnership with Saudi Arabia (2006): সৌদি-আমেরিকান সম্পর্ক।

৩.৩. শীতল যুদ্ধ ও আফগান জিহাদ:শীতল যুদ্ধের সময় (১৯৪৫-১৯৯১) যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে সোভিয়েত প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে। ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিরোধী মুজাহিদিনদের সমর্থনে সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্র একত্রে কাজ করে। সৌদি আরব এই সময়ে তেলের আয় ব্যবহার করে ওয়াহাবি ভাবধারা প্রচারে অর্থায়ন করে, যা আল-শেখ পরিবারের প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।পশ্চিমা সমর্থন সৌদি রাজপরিবারের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে, যা পরোক্ষভাবে ওয়াহাবি ভাবধারার প্রসারে অবদান রাখে।

তথ্যসূত্র:Steve Coll, Ghost Wars: The Secret History of the CIA, Afghanistan, and Bin Laden (2004): আফগান জিহাদে সৌদি ও পশ্চিমা ভূমিকা।Thomas Hegghammer, Jihad in Saudi Arabia: Violence and Pan-Islamism since 1979 (2010): ওয়াহাবি ভাবধারার প্রসার।

৩.৪. বর্তমান প্রেক্ষাপট (২০২৫ পর্যন্ত):পশ্চিমা দেশগুলো সৌদি আরবের সাথে অস্ত্র চুক্তি, তেল বাণিজ্য এবং ভিশন ২০৩০ প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এই সমর্থন আল-সৌদ পরিবারের ক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়ক।তবে, মুহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে, যা আল-শেখ পরিবারের প্রভাবকে কিছুটা হ্রাস করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতা হ্রাস এবং সামাজিক সংস্কার এই প্রক্রিয়ার অংশ।

তথ্যসূত্র:Reuters, “Saudi Arabia’s Vision 2030 and Religious Reforms” (2023): ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর রাজপরিবারের নিয়ন্ত্রণ।The Guardian, “Saudi Arabia and the West: A Special Relationship?” (2022): বর্তমান পশ্চিমা-সৌদি সম্পর্ক।

সার সংক্ষেপসৌদি রাজবংশ (আল-সৌদ): আল-সৌদ পরিবার একনায়কতান্ত্রিক রাজতন্ত্র, তেলের সম্পদ, সামরিক শক্তি এবং ধর্মীয় বৈধতার মাধ্যমে সৌদি আরবে ক্ষমতা ধরে রেখেছে। ভিশন ২০৩০ এর মাধ্যমে তারা জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার করছে।আবদুল ওয়াহাবের পরিবার (আল-শেখ): আল-শেখ পরিবার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রভাব বজায় রাখে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে না। তাদের প্রভাব ওয়াহাবি ভাবধারার প্রচার এবং ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে সীমাবদ্ধ।

পশ্চিমা বিশ্বের অবদান: ব্রিটিশ সমর্থন (১৯১৫-এর Treaty of Darin), আমেরিকান তেল শিল্পের সহযোগিতা, এবং শীতল যুদ্ধের কৌশলগত জোট আল-সৌদের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। এই সমর্থন পরোক্ষভাবে ওয়াহাবি ভাবধারার প্রসারে অবদান রাখে, যা আল-শেখ পরিবারের প্রভাব বাড়ায়।

বর্তমান প্রেক্ষাপট: মুহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আল-শেখ পরিবারের প্রভাব কিছুটা হ্রাস করেছে। তবে, পশ্চিমা সমর্থন আল-সৌদের ক্ষমতা ধরে রাখতে এখনও গুরুত্বপূর্ণ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...