ইচ্ছা ( চতুর্থ পর্ব )

গল্প: ইচ্ছা (পর্ব – ৪)
(একটা পাশ, একটা ফাঁকা গুহা)

“আদর পাশ কইরা গ্যাছে গো!”

পাথরঘাটার গাঁয়ে একটা চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে। কেউ খুশিতে, কেউ অবিশ্বাসে, কেউ হিংসায়—তবু শব্দটা চারদিক ঘিরে ফেলে।

ইচ্ছার চোখে জল, বুকভরা গর্ব। গরিবের ছেলে, ভাঙা চটি পরে, চারখানা জামায় কেটে গেল ক্লাস নাইন-টেন। তবু পাস করল—অন্য কারো সাহায্য ছাড়া, কোচিং ছাড়া, বড় স্কুল ছাড়া।

আদর মুখ চুন করে বসে থাকে, অথচ পাশ করার খুশি নেই তার চোখে। ইচ্ছা পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, “তুই তো আমার গর্ব, বাপ। পাশ কইর‌্যা দেখাইলি, গরিবের পোলা বইলা কেউ ফেল হয় না।”

আদর মাথা নেড়ে, “হ, পাশ তো করলাম। তারপর?”

এই “তারপর?” ইচ্ছাও জানে না। তার ভাবনার গণ্ডি ক্লাস টেন পর্যন্তই ছিল। কলেজ? ফর্ম ফিলআপ? কোচিং? নতুন খরচের ধাক্কা? তার চোখ কাঁপে, মন ব্যথা করে।

ইচ্ছা এখন আগের থেকেও বেশি কাজ করে। সকালে একজনের বাসায় রান্না, দুপুরে হোটেলে গামছা ধোয়া, বিকেলে টিউশন বাড়ির ছাদে কাঁথা সেলাই। শরীর যেন চোয়াল শক্ত করে বেঁচে থাকে, শুধু ছেলের মুখ দেখে।

তবে আদর এখন বদলে গেছে।

আগে বইয়ের পাতা খুললে মা তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকত, “বুঝতেছিস?”—এখন সে মুখ গুঁজে থাকে মোবাইলের স্ক্রিনে, যা একদিন এক “ভালো দাদা” তাকে উপহার দিয়েছিল।

এই “ভালো দাদা” স্কুল পাড়ারই, শমসের। তার বয়স বাইশ, মাথায় কালো ব্যান্ড, হাতে রুপার ব্রেসলেট। ছেলে পেটায়, মদ খায়, কিন্তু খুব ভালোবাসে বলে আদরকে “ছোট ভাই” বানায়।

ইচ্ছা একদিন দেখে, ছেলের মুখে নতুন ভাষা, চোখে নতুন রং। বলে, “মা, সব কিছুতেই তুই বাধা দিস কেন? আমি কি আর ছোট?”

ইচ্ছা কাঁপে, তবে চুপ করে যায়। তার মনে পড়ে, সে নিজেও তো পনেরোতে বিয়ে হয়েছিল। তার ভিতরে কী ছিল—সেই ভয়, সেই নিঃসঙ্গতা—আদরের মাঝেও সে যেন খুঁজে পায়।

রাতের অন্ধকারে ইচ্ছা উঠে দেখে, ছেলে নেই। অজানা ভয় বুক কাঁপায়। পুকুরপার দিয়ে হাঁটে, বাজারের পাশ দিয়ে, শেষমেশ দেখে, শমসের সাথে আদর চা খাচ্ছে।

“তুই এখানে কী করিস, বাপ?”

আদর তাকায় না। বলে, “মা, আমি একটু বড় হইছি। সবসময় খালি খালি ভয় পাইস না।”

সেই রাতে ইচ্ছা ঘুমোতে পারে না। তার মনে হয়, তার আদর—যে একদিন তার বুকের মধ্যে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাত, যে তার কাঁথা সেলাইয়ের বুনোটে বাঁধা—সে কি দূরে সরে যাচ্ছে?

স্কুলজীবনের অবহেলা, গরিব ঘরের ছেলেদের যে কদর নেই, সেটা সে অনুভব করে বহুদিন। শিক্ষকরা বলেন, “তোমাদের থেকে তো এমন কিছু আশা করি না।” আদর মুখ বুঝে শুনেছে সবসময়। এখন সে বুঝতে শিখছে, এই সমাজে শুধু ভালো ছেলে হইলেই হয় না—চালাক, সাহসী, ‘জুগাড়ু’ হতে হয়।

এখন আদর আর আগের মত খাতা নিয়ে বসে না। তার মাথায় প্রশ্ন ঘোরে—“আমি কি আসলেই কিছু হব?” মা শুধু বলে, “হবি বাপ, হবি।” কিন্তু কেমনে? কীভাবে? কেউ কিছু শেখায় না। পাড়ার কলেজের ছেলেরা তাদের মতো ঘুরতে শেখায়, কথা বলতে শেখায়। আর শমসের দল শেখায়—মাথা ঠান্ডা রাখিস, টানলে সব হইয়া যায়।

মাঝে মাঝে ইচ্ছা আদরের জিনিসে গন্ধ পায়—একরকম ধোঁয়ার গন্ধ, অন্যরকম কিছুর ঘ্রাণ। চোখে-মুখে দেখলে বুঝতে পারে, কিছু একটা পাল্টেছে।

কিন্তু মা হিসেবে সে চুপ করে যায়। ভাবে, “নাহ্, আমার আদর, সে এমন কিছু করতেই পারে না।”

অথচ সে জানে, ছেলেটার ভিতরে ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছে—যেটা মায়ের ভালোবাসায় পুরা যায় না, যেটা বন্ধুদের হাসি বা ক্লাসের রেজাল্টে ধরা পড়ে না। এই ফাঁকা জায়গায় একদিন ঢুকবে এমন কিছু, যেটা মাটি থেকে কেঁড়ে নেবে ওকে।

তবে তাও ইচ্ছা হারে না। সে ফর্ম কিনে দেয় কলেজে ভর্তি করানোর জন্য, পুরানো ব্যাগে নতুন ব্যাজ সেলাই করে, ছেঁড়া জুতার নিচে নিজে গাম লাগায়।

সে জানে না আদর কলেজে যাবে কি না, পড়বে কি না—তবু চেষ্টা থামে না। শুধু রাতে চুপিচুপি প্রার্থনা করে, “ভগবান, ওরে ঠিক রাখিস। আমার বুকটা ফাইটা যাইব না তো?”

আদরও মাকে ভালোবাসে—সেটা সে প্রকাশ করে না, কিন্তু বন্ধুদের বলে, “আমার মা যা করছে, কেউ করে না।” তবু মায়ের সামনে গিয়ে সেই শব্দ হারিয়ে ফেলে।

এইভাবে মা-ছেলের মাঝে থেকে যায় একটুকু দূরত্ব—অভিনয়ের মতো, জেদির মতো, অব্যক্তের মতো।

এবং এই দূরত্ব, একদিন তৈরি করবে এমন গল্প, যেটা কেবল বেদনার।

(চলবে...)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...