গল্প: ইচ্ছা (পর্ব - ৩)
গল্প: ইচ্ছা (পর্ব - ৩)
(একলা ছেলেটা, একগুঁয়ে মা)
পাথরঘাটা গ্রামের শেষপ্রান্তে ইচ্ছার কুড়ে ঘর এখন আর আগের মতো নীরব না। ভোর হইতেই কুয়োর জল ওঠে, হাঁড়িতে চিঁড়ে ভিজে, আর স্কুল ব্যাগ গুছাতে বসে যায় আদর। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হইছে মাত্র তিনমাস, কিন্তু মুখে কথা বইলেই বোঝা যায়—মায়ের মতনই একগুঁয়ে, একটু চুপচাপ, তবে চোখে একরকম আগুন।
ইচ্ছা হের সব কষ্ট বুকের নিচে চাপা দিয়ে হাসে। নিজের আধখানা গামছা ছিঁড়ে বানায় ছেলের ঘরোয়া জামা। পাড়ার হাট থেইকা পুরনো খেলনার দোকানদারর লগে মিষ্টি হেসে কয়, “ভাই, এই ট্রাকখানির চাকা ভাঙা, দাম কমা দিবেন?” ছেলে কাঁদবে না বলে সে একজোড়া বাটন দিয়ে চাকা বানায় খেলনার।
আদরের কাছে সবই আছে—একজোড়া সস্তা চটি, হ্যান্ডমি-ড খাতা বাইনডিং, চার রঙের পেন্সিল, তিনটা খেলনা, আর একখান ছেঁড়া সোনার ঘুড়ি। কিন্তু একটা জিনিস তার কখনোই ঠিকমতো জোটে না—সাথী।
স্কুলে গিয়া প্রথমেই সে টের পাইসে, তার গায়ের জামা বাকিদের মতো চকচকে না। টিফিনে তার ব্যাগে চিড়া-মুড়ি থাকে, বাকিদের রঙিন কেক। স্যারদের কাছে সে "ইচ্ছার ছেলে"—মানে, যার মা হোটেলে রান্না করে। কিছুই মুখে বলা হয় না, তবু আদরের চোখে লেগে থাকে ওই ফারাকের জ্বালা।
একদিন রচনা লেখার সময় হেডস্যার বলে, “তোমরা লেখো, ‘আমার পছন্দের খেলনা’। কারও ট্রেন, কারও রোবট, কারও কার। আদর কি লেখে জানো? —‘আমার পছন্দের খেলনা চাকা ভাঙা একটা ট্রাক। আমি নিজেই বানাইছি, মায়ের সেলাই দেওয়া।’” ক্লাসে হাসির রোল ওঠে। আদর চুপ।
ঘরে ফিরলে ইচ্ছা বুঝে ফেলে, আজ আবার কেউ ব্যথা দিয়েছে। আদর চুপচাপ গুমরে গুমরে বলে, “মা, আমি কি আসলে গরিব?”
ইচ্ছা থমকে দাঁড়ায়। পুকুরঘাটের ধারে বসে ওর কাঁধে হাত রাখে, “গরিব রে কেউ চেহারায় চিনে না, মন রে চিনে। তুই মন দিয়া পড়, বাকি আমি দেখে নেব।”
তবে তাতে সমাজ থামে না। স্কুলে গার্জিয়ান মিটিং হয়, ইচ্ছা ফিটফাট না হইলেও কুড়িয়ে পাওয়া শাড়ি পরে যায়। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে সে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্য মা-বাবা চেয়ার দখল করে বসে। হেডস্যার একবার চোখ তুলে দেখে, “ও ইচ্ছা এসেছে…” তারপর আর কোনো কথা নেই। যেন তার মত গরিব গার্জিয়ানদের কথা বলার দরকারই পড়ে না।
তবু ইচ্ছা পিছায় না। ক্লাসে খাতা জমা না দিলে ছেলের পিঠে মার পড়ে—সে গলির বাঁধা খাতা দোকানে খাতা বাকিতে নেয়। পাড়ার মাস্টারমশায়ের পা ধরে, “ভাই, আদররে সন্ধ্যায় আধা ঘণ্টা পড়ায় দেন। আমি ঘর মুছি, চানাচুর দিই।” কেউ রাজি হয়, কেউ টালবাহানা করে। ইচ্ছা চায় না, ছেলের ভবিষ্যৎ তার মতন গলির ধারে পড়ে থাকুক।
আদর যদিও পড়ে, তবে চুপচাপ হয়ে যায়। খেলার মাঠে গেলে ছেলেরা বলে, “আরে তুই তো ভাঙা ট্রাক ওয়ালা।” ইচ্ছার কানে এসব কথা আসে না, তবে সে দেখে ছেলের মুখের রঙ ফ্যাকাশে। একদিন সে আদরের হাত ধরে বলে, “তুই কারো কথায় কান দিস না। তোর মা তোকে পৃথিবীর সব দিবে, শুধু মন খারাপ করিস না।”
কিন্তু মন কি এমনেই ভালো থাকে? ছোট ছেলে, মনের মধ্যে জমে যায় না বলা কত কথা, না-পাওয়া কত ক্ষোভ। এই ক্ষোভই একদিন তাকে টেনে নিয়ে যাবে এমন পথে, যেখান থেইকা ফেরার রাস্তা থাকে না।
সেইদিনের কথা, গ্রামের বড় বাজারে ইচ্ছা গেছিলো এক বাড়িতে রান্নার কাজে। হঠাৎ শুনে, আদর স্কুল থেইকা আসেনি। দৌড়ে হাপাতে হাপাতে সে স্কুল যায়, সেখান থেইকা পুকুর পারে, বাজারে—কোথাও ছেলে নাই। অবশেষে দেখে, আদর একা বসে আছে গাছতলায়, চোখে জল।
“কি হইছে বাপ?”
আদর কিছু বলে না। তারপর হঠাৎ বলে ফেলে, “মা, আমি বড় হইয়া অনেক ট্যাকা কামাই করব। আমি তোদের মতো হব না। আমি স্যারদের মত, গাড়ি-ঘোড়ার মত হব।”
ইচ্ছা কাঁপে, কিন্তু মুখে বলে, “হ বাপ, হবি তো। তোর মায়ের কষ্ট একদিন সার্থক হবে।”
কিন্তু এই কথার আড়ালে যে আগুন জ্বলছে, ইচ্ছা তখনও তা টের পায় না। আদর বড় হচ্ছে, চুপচাপ, কল্পনার ভিতর, অনেক না-পাওয়ার হিসেব কইরা কইরা।
---
(চলবে...)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন