ইচ্ছা পর্ব -২

গল্প: ইচ্ছা (পর্ব - ২)
(আদর আর লড়াইয়ের শুরুর গল্প)

আদর জন্মানোর পর থেইকা ইচ্ছার দিনরাত কইম্যা যায়। পেট চালানো, ছেলেরে বড় কইর‌্যা তোলা, এত কিছু একা মানুষর পক্ষে কেমনে সামাল দিব! মাসীর ঘর থেইকা যে কদিন ঠাঁই পাইছিল, তাও ভিজে ধানের চটের মতন শুকাই গেল। মাসী কইল, “তোর ছেলে হইছে, এখন নিজের পেট নিজে চালা। আমি আর পারুম না।”

তাই একদিন গাঁতালার এক মাষ্টারমশায়ের বাড়ি রান্নার কামে ঢুকল। ঘরের বউ-মেয়ে ভাল, ইচ্ছার কাজেও সন্তুষ্ট। কিন্তু মাস ঘোরার আগেই মাষ্টারমশায়ের চোখের ভাষা বদলাই গেল। একদিন দুপুরবেলা বউ বাড়ি নাই, মাষ্টারমশায় ডেকে বলে, “তুই তো ভাল রান্ধস, একটু আলাদা করে রাঁধলি না আমার জন্য?”

ইচ্ছা টের পাইসে—এই কটকটা কথা মানে কিছু একটা খারাপের ইশারা। তারপর, একদিন ঠিকই চিপা ঘরে হাত ধইরা কয়, “আমার একটু মন ভালো করায়ে দে, তোর বেটার ভবিষ্যৎ তো ঠিক কইরা দিব।” ইচ্ছার মুখ রাঙা হইয়া ওঠে, হাত ছুঁড়‌্যা কয়, “আমার গা তো ভাত রাঁধে, ভালোবাসা না।”

পরদিন হঠাৎ কইর‌্যা তারে চাকরি থেইকা ছাড়ায়া দিল। এইভাবেই একটার পর একটা জায়গা—বেশিরভাগই পড়াশোনা জানা লোক, নামডাক আছে—কিন্তু তাদের চোখের কামনা এক জিনিস চায়। ইচ্ছার শরীর।

এক হোটেলর রান্নাঘরে কাজ ধরেছিল—সেখানে মালিক প্রথমে খুব ভদ্র। কয়, “তুই আমার মায়ের মতন, চিন্তা করিস না।” কিন্তু রাতে দোকান বন্ধের পরে বলে, “তোর মতন মেয়ে তো কেউ দ্যাখি নাই, বড় চওড়া বুক, বড় মন।” আবারো একই খেলা। ইচ্ছা একদিন মুখ ধইরা কাঁদতে কাঁদতে কয়, “আমি গরিব, তয় ইজ্জত আছে, দয়া কইর‌্যা ছাইড়া দাও।”

শেষমেশ এইসব জায়গায় কইম্যা, ঝাঁট-বাহার-কড়াই ধুইয়া, কষ্টে কষ্টে পয়সা জমাই। একটা ভাঙা চালের নিচে উঠতে পারে। তিনখানা কাঁথা, একখানা ছেঁড়া মশারি, আর এক হাঁড়ি ভাত—এই নিয়েই সংসার।

তবে আদর তার সব। ছোট্ট মুখ, গায়ে গন্ধ আছে মাটির, চোখে সোনালী স্বপ্ন। ইচ্ছা প্রতিরাতে কপালে হাত বুলায়ে কয়, “তুই পড়বি, হবি মাস্টার। তোর মা যেন গামছা হাতে আর কাঁদতে না হয়।”

একদিন পয়সা জোগাড় কইর‌্যা ছেলেকে নিয়া সরকারি স্কুলে গেল ভর্তি করাতে। স্কুলের দারোয়ান প্রথমে অবিশ্বাসে তাকায়, “তোমার ছেলে?” ইচ্ছা গলার স্বরে শক্তি আনে, “হ, আমার আদর, ভর্তির লাইগা আইছি।”

বই-খাতা আর নতুন একটা হাফ প্যান্ট কিনে দেয়ার মতো পয়সা ছিল না। তবু হেডস্যারর কানে তার কাহিনি গেলে ভর্তি হইয়া গেল ছেলেটা। সেইদিন স্কুল থেইকা বাইর হইতেছিল আদর, মুখভর্তি হাসি, হাতে বই, চোখে আনন্দ—বলে, “মা, আমি কি সাচ্চি স্কুলে গেলাম?”

ইচ্ছা চুপচাপ তার মাথায় হাত রাখল। চোখের কোণে জল জমে, তাও গলায় বলে, “হ বাপ, তুই স্কুলে গেছিস। এখন তোর পড়া, তোর খাতা, তোর পেনসিল—এইহানে আমার স্বপ্ন, আমার লড়াই।”

তখন সন্ধ্যা নামে পাথরঘাটার গাঁয়ে। ধানখেত থেইকা হাওয়া আসে। ঝিঁঝিঁ ডাকে। আর সেই কুড়ে ঘরের ভিতর মা ও ছেলে কাঁথা মুড়ি দিয়া নতুন ভোরের স্বপ্ন বুনে।

(চলবে...)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...