খোট্টা

[ বিনিময় অবিরাম । ০৮.০৪.২৩ ]
.
গত ২০২১-এর ৫ এপ্রিল থেকে আজ ৮ এপ্রিল তক মোট চার কিস্তিতে আপনাদের মামুলি পাঠকের সামান্য এক মতামত দৈনিক পুবের কলম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সম্মানীয় সম্পাদক-সহ পত্রিকাগোষ্ঠীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। নিবন্ধটির রচনাকালে কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকার অভিমত ও পরামর্শ পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছি। তাঁদের প্রতি রইল শ্রদ্ধা ও সালাম। ফেবু এবং পত্রিকার মাধ্যমে অনেকেই প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তাঁদের সকলের প্রতি রইল মুবারকবাদ ও ভালোবাসা। তাঁদেরই প্রত্যাশা পূরণে অধমের পুরো নিবন্ধ ফেবুতে দেওয়ার দুঃসাহস।   
.
প্রাইমারি স্কুলের পাঠ্যসূচিতে রিনার বন্ধু আমিনা : এক প্রারম্ভিক পর্যবেক্ষণ
++++++++++++++++++++++++++++++++++++++                          
.
বছর দুয়েক আগের কথা। পরিচিত এক অসরকারি বাংলা মাধ্যম নার্সারি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করি। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৯৫ শতাংশ পড়ুয়া মুসলিম সমাজের। বাকিরা প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের। আলাপের যে বিষয়টি বিস্মিত ও চিন্তিত করে সেটি নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে এক কঠিন বাস্তবতা। প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক মুসলিম হলেও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অধিকাংশই অমুসলিম। প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণির শিশুদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, মুসলিম পড়ুয়াদের কেউ কেউ বাংলায় কথা বলার সময় সহজ নয়। বিশেষকরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে এই প্রবণতা ছিল বেশি। প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সামনে বিষয়টির প্রসঙ্গ তুললে তাঁরা যা শোনালেন সেটি শুনে তাজ্জব বনে যাই। জানলাম, বাড়িতে এ-সব ছাত্র-ছাত্রীরা আব্বা-মা ও পরিবারে ‘খোট্টা’ ভাষায় কথা বলে থাকে। বাড়িতে চলে খোট্টা ভাষায় আদর, পেয়ার, স্নেহ, প্রীতি, সোহাগ, ভালোবাসা, ভাব, ভাবনা, আবেগ, অনুভূতি, কথা চালাচালি। অর্থাৎ স্কুলটুকু ছাড়া তাদের বলা-চলা-কওয়া সবকিছুই খোট্টাময়। স্কুলে বাংলা এবং বাড়িতে খোট্টা হওয়ার অসুবিধের কথা শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্বীকার করে নিলেন। একজন শিক্ষিকা জানালেন কেউ কেউ পরীক্ষায় খাতায় খোট্টা শব্দও লিখে ফেলে। যেমন, বিভিন্ন স্বাদের উদাহরণে মিষ্টি, তেঁতো, টক লিখতে গিয়ে দু-একজন লিখেই ফেলে মিষ্টি, তেঁতো, খাট্টা। কারণ খোট্টায় টক হল ‘খাট্টা’।     
উল্লেখ্য, খোট্টাভাষীরা রাজ্যের একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। এঁরা সবাই মূলত মুসলিম সম্প্রদায়ের। খোট্টা মুসলিমরা নিজেদের বাড়িতে খোট্টা ভাষায় কথা বলে। এই ভাষা একটি উপভাষার ধরন, হিন্দি, উর্দু ও বাংলার মিশ্রণ। তবে এঁরা সকলেই দ্বিভাষিক এবং বাংলায় কথা বলে ও বাংলা ভাষা শেখে, কারণ খোট্টা ভাষার কোনও লিখিত রূপ নেই। বর্তমানে ভাষাটি কেবলমাত্র একটি আন্তঃসম্প্রদায়গত কথোপকথনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলা ভাষা হলো এদের শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম। খোট্টা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা রাজ্যে প্রায় দশ লক্ষাধিক। মালদহ জেলায় বেশি  এবং মুর্শিদাবাদের কিছু এলাকায়, যেমন সুতি, সমশেরগঞ্জ, ফরাক্কা, জঙ্গিপুরের বিক্ষিপ্ত অংশে কথ্যভাষা হিসাবে খোট্টার প্রচলন বহু আগে থেকেই। সাবেক মেদিনীপুর জেলার কোন কোন অংশে খোট্টাভাষী মানুষের বসবাস আছে। বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ি সহ জেলার রাজনগর, খয়রাশোল,দুবরাজপুর থানার বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে এখনও বহু মানুষ আছে,যারা ‘খোট্টা’ ভাষী। যেহেতু পূর্বতন বিহার রাজ্য থেকে পূর্বপুরুষদের আগমনসূত্রেই বীরভূমে এই ভাষার প্রচলন, তাই বর্তমানের ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন উত্তর প্রান্তিক বীরভূমের বহু গ্রামাঞ্চলে বাংলার এই খণ্ড উপভাষাটির দেখা মেলে। এঁরা এখন ভারত সরকার কর্তৃক ওবিসি সংরক্ষণের আওতাভুক্ত। বাংলা ও হিন্দি-উর্দুর মিশেলে সৃষ্ট ‘খোট্টা’ বাংলাভাষার একটি খণ্ড উপভাষা (Sub-dialect) হিসাবে ভাষাবিদদের কাছে স্বীকৃত।
.
আমিনা-হালিমা-খাদিজা-আয়েশা-ফাতেমা 
------------------------------------
কলম্বিয়া এনসাইক্লোপিডিয়া (২000)-এর ষষ্ঠ সংস্করণ অনুসারে, ভিন্নতা সহ মুহাম্মদ সম্ভবত বিশ্বের সর্বাধিক সাধারণ নাম। এটি অনুমান করা হয় যে ইসলামের মহানবী মুহাম্মদ(সা.)-এর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বিশ্বের ১৫ কোটিরও বেশি পুরুষ ও ছেলেরা মুহাম্মদ নামটি বহন করে। উল্লেখ্য, যাঁদের নাম মুহাম্মদ নয়, তাঁদেরও অনেকের নামের সঙ্গে আগে, পেছনে বা মাঝে মুহাম্মদ জড়িয়ে থাকে। যেমন, মোগল সম্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর ( ১৫৪২-১৬০৫), ভারতের একাদশ-তম প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হিদায়াতুল্লা ( ১৯০৫-১৯৯২), ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ( ১৮৮৫-১৯৬৯) প্রমুখ। আমরা যদি পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলিম পুরুষদের নামের পর্যালোচনা করি তাহলে এখানেও সেই ধারা বিদ্যমান। সঙ্গে এটিও লক্ষনীয় গোটা উপমহাদেশে আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান এবং বিশেষকরে উভয় বাংলায় নজরুল নামের প্রতি আলাদা একটা টান আছে। এতো গেল পুরুষের ক্ষেত্র।
মেয়েদের নামের ক্ষেত্রে সেরকম কোনো সমীক্ষা হয়েছে কিনা জানা নেই। আমিনা, হালিমা, খাদিজা, আয়েশা/আয়িশা ও ফাতেমা/ফাতিমা—এই পাঁচ নামই পছন্দের তালিকায় সম্ভবত এখনো উপরের দিকে। পরিচয়ে এঁরা মহানবীর মা আমিনা  বিন্ত ওহাব, দুধমাতা হালিমা আস্ সাদিয়া, স্ত্রী খাদিজা বিন্ত খুওয়াইলিদ ও আয়িশা বিন্ত আবু বকর এবং কন্যা ফাতিমা বিন্ত মুহাম্মদ। বাংলার মুসলমান সমাজে এই সব নামেরই সবচেয়ে বেশি আনাগোনা। বছর খানেক আগে এক আত্মীয়ের মুখে অপ্রত্যাশিত এক ঘটনার সাক্ষী হই। তাঁদের কন্যা প্রথম দিন স্কুল থেকে ফিরে এসে হাসতে হাসতে বলে— ‘মা জানো… আমার নাম বইয়ে দেখে আমার বন্ধুরা আমাকে খুব লাগায়।’ তার মা কৌতূহলী হয়ে বই দেখতে চায়। তৃতীয় শ্রেণির সেই বইয়ে তিনি পড়লেন —‘আমিনা বলল—তবে লুকোচুরি খেলতেও খুব ছুটতে হয়।’ আমিনার সঙ্গে আলাপ করলাম। ছটফটে আমিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, বইয়ে তোমার নাম দেখে তুমি খুশি তো! অমলিন মিষ্টি হাসির অভিব্যক্তিই জানান দিল সম্মতি। উল্লেখ্য, বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পে গফুরের মাতৃহীন মেয়ে আমিনার নাম চিরস্মরণীয়।
.
সুমনা এবং সানিয়া
-----------------
২০১৭-এর জানুয়ারির শেষে ক্লাস থ্রি-এর পরিবেশ বই নিয়ে হঠাৎ করে এক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায় ভয়ানক সব বিদ্বেষ, বিরাগ, গরল ও হিংসার দাপাদাপি চলল বেশ কয়েক মাস। ঘটনাটা হল, বামফ্রন্ট সরকারের বিদায়ের পর নতুন সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি ‘বিশেষজ্ঞ কমিটি’ গঠন করেন। সেই কমিটির প্রস্তুতকৃত বইই বর্তমানে রাজ্যের প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে পাঠ্য। সেরকমই এক পাঠ্যবই তৃতীয় শ্রেণির ‘আমাদের পরিবেশ’। বইটিতে প্রকৃতি ও মানবজীবনের বিভিন্ন সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে।
  বইয়ের এক অধ্যায় ‘পরিবার’। এখানে পরিবার ও পরিবারের শাখাপ্রশাখার পাঠ ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানো হয়েছে। শুরুটা এরকম—
‘সুমনার আজ খুব আনন্দ। ছোট ভাইকে নিয়ে ঠাকুমা, কাকা আর কাকিমা এসেছেন। সুমনা এবার দিদি হয়ে উঠল। ক্লাসে এসে সুমনা এসব বলল।
শুনে দিদিমণি বলেন— মানে, তোমাদের পরিবারে একজন বাড়ল।
হামিদ বলল—পরিবার মানে?
তিতলি বলল--জানিস না ? বাড়ির সবাই মিলে পরিবার হয়।
দিদিমণি বলল—তা বলতে পারো।’
দিদিমণি এভাবেই সুমনাদের পরিবারের সবচেয়ে বড়ো ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, দাদু, দিদিমা থেকে শুরু করে পিসিমা, কাকা, বাবা, মা, মামা, মাসিমা, পিসেমশাই, কাকিমা, মামিমা, মেসোমশাই, ভাই, দিদি, সুমনার নাম বোর্ডে লিখে বললেন এটি সুমনাদের পরিবারের শাখা-প্রশাখা। ক্লাসের সবাই ওই লেখা মন দিয়ে দেখল। কিছুক্ষণ পরে সানিয়া দিদিমণিকে তাদের পরিবারের শাখা-প্রশাখা লিখে দেখাতে চাইল। দিদিমণি সানিয়াকে লিখতে বলল। দিদিমণির বোর্ডের লেখার মতো সানিয়াও তাদের পরিবারের বড়োদের দিয়ে শুরু করল। সে লিখল--দাদা, দাদি, নানা, নানি, ফুফুআম্মা, চাচা, আব্বা, আম্মা/মা, মামা, খালাআম্মা, ফুফা, চাচিআম্মা, মামিমা, খালু, আপা/বুবু, ভাইয়া, সানিয়া…।
ব্যস, শুরু হয়ে গেল গণ্ডগোল। বাংলা ভাষায় দাদি, নানা, নানি, আব্বা, আম্মা, খালা, ফুফা…এসব আবার কি! বিশেষত শহুরে শিক্ষিতজনের অভিমত পড়ে মনে হয়, বাংলা ভাষার পবিত্র অঙ্গ যবনস্পর্শে যেন হয়ে গেল অপবিত্র। সরকার, বিশেষজ্ঞ কমিটি বিশেষকরে চিরনিন্দিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও তার মানসকে আঘাতের পর আঘাতে করা হয় ক্ষতবিক্ষত। এক শ্রেণীর মানুষ সবকিছুতেই সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতা ও জামাই আদর আখ্যান আবিষ্কারে সুখটান দিয়ে অপ-আনন্দ লাভ করেন। তাঁদেরই এক প্রতিনিধি তথাকথিত শিক্ষিত তরুণের প্রশ্ন--আব্বা, আম্মা, নানা, নানি, ফুফা ইত্যাাদি কি বাংলা শব্দ? এবং প্রশ্নের পরেই তার নিদান হল, বাংলা বইতে বাংলাই শেখানো হোক। অর্থাৎ এগুলো বাংলা শব্দই নয়।  সবচেয়ে অবাক করা এক মন্তব্য সেসময় পড়েছি। ভেবেছি, সাম্রাজ্যবাদী ম্যাকলে এরকমই ‘শিক্ষিত’ শ্রেণির মাধ্যমে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে চিরকালীন বিদ্বেষ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের অধ্যাপক তিনি। শুনুন, ইংরেজিতে লেখা তাঁর বিজ্ঞানময় অমৃত বানীর বাংলা অনুবাদ:  ‘ বাচ্চাদের কি বাংলা না উর্দু মাধ্যমে পড়ানো হচ্ছে? বাংলায় মাদার হলেন মা এবং ফাদার হলেন বাবা। আপনি যদি উর্দুতে পড়াচ্ছেন তবে আব্বু বলুন বা যা ইচ্ছে বলুন। কেবলই এক সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার জন্য এই বদল।’ সোশ্যাল মিডিয়ায় ইচ্ছেকৃতভাবে তথ্য বিকৃত করে প্রচার চলে, বাবা, মা, কাকা, পিসি, মাসি ইত্যাদি শব্দগুলো তুলে দিয়ে আব্বা, আম্মা, চাচা, ফুফু, খালাম্মা শব্দগুলো বইয়ে ঢোকানো হয়েছে। এমনকি কয়েকটি পত্রপত্রিকাও প্রকৃত সত্য যাচাই না করে অপপ্রচার ও বিদ্বেষে যোগ দেয়। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক আর যেন কিছুতেই পিছু হটে না।
  আম্মা, আব্বা ইত্যাদি শব্দ নিয়ে যেভাবে রাজ্যজুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে এবং তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের এক অংশ যেভাবে এই বিতর্কে ইন্ধন জুগিয়েছে, বেদনাদায়ক হলেও সেটি বাস্তব। এই পরিসরে সংখ্যালঘু সমাজের এক যুবকের বয়ান ছিল রীতিমত চিন্তার। তাঁর মতে—‘মুসলমান পরিবার ও সমাজে প্রচলিত এই কয়েকটা শব্দ পাঠ্যবইয়ে রাখায়  বাংলাভাষার যদি জাত যায়, যদি সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পায়, তাহলে শব্দগুলোকে বই থেকে নির্বাসন দিয়ে দেওয়া হোক। এতে অন্তত  সাম্প্রদায়িকতা কমবে। কেউ আর আওয়াজ তুলতে পারবে না, এটা মোল্লাদের দেশ হয়ে যাচ্ছে। শুধু পাঠ্যবইয়ে অসাম্প্রদায়িকতা নয়, বাস্তবেও অসাম্প্রদায়িকতা চাই। আর পাঠ্যবইয়ে থাক কিংবা না থাক, মুসলিমরা জন্মদাতাকে আব্বা-ই বলবে।’ দহনে কতোটা দগ্ধ হলে, মানসিকভাবে কতোটা বিপর্যস্ত হলে, মনে এ-ভাবনার সৃষ্টি হয় সেটি সহাবস্থানবাদী সহানুভূতিশীল নাগরিকের পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন নয়। 
.
সামান্য অতীতকথা
-----------------
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় আজ থেকে শতবর্ষ আগের শিশুপাঠ্যেও সানিয়া ও তার পরিবার ব্রাত্য ছিল। সেকালেও এ নিয়ে বাক বিতণ্ডা কম হয়নি। অন্যান্য বহু মুসলিম সাহিত্যিক ও লেখকদের পাশাপাশি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-কেও বলতে হয়েছিল—‘‘ কি পরিতাপের বিষয়, আমাদের শিশুগণকে প্রথমেই রাম শ্যাম গোপালের গল্প পড়িতে হয়। সে পড়ে গোপাল বড় ভালো ছেলে। কাশেম বা আব্দুল্লাহ কেমন ছেলে সে তাহা পড়িতে পায় না। এখান হতেই তাহার সর্বনাশের বীজ বপিত হয়। তারপর সে তাহার পাঠ্যপুস্তকে রাম-লক্ষ্মণের কথা, কৃষ্ণার্জুনের কথা, সীতা-সাবিত্রীর কথা, বিদ্যাসাগরের কথা, কৃষ্ণকান্তের কথা ইত্যাদি হিন্দু মহাজনদিগেরই আখ্যান পড়িতে থাকে। সম্ভবত তাহার ধারণা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের বড় লোক নাই। এই সকল পুস্তক দ্বারা তাহাকে জাতীয়ত্বহীন করা হয়। হিন্দু বালকগণ ওই সকল পুস্তক পড়িয়া মনে করে আমাদের অপেক্ষা বড় কেহ নয়। মুসলমানরা নিতান্তই ছোট জাত। তাহাদের মধ্যে ভাল লোক জন্মিতে পারে না। এই প্রকারে রাষ্ট্রীয় একতার মূলোচ্ছেদ করা হয়।’’ ( আমাদের সাহিত্যিক দরিদ্রতা, আল-এসলাম, ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৩)  অন্যান্য প্রসঙ্গ বাদ দিলেও বিদ্যালয়ে শিশুদের পাঠশুরুকালে নিজ বইয়ে তারা নিজের, নিজেদের পরিচিত নামধাম দেখতে পায় না। এই অপরিচয় যে শিক্ষার প্রতি তাদের ভালোবাসা ও ভবিষ্যৎ মানস গঠনে প্রতিবন্ধক সেটি শিশুশিক্ষা-বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ দ্বারা বারে বারে উচ্চারিত।
  সম্প্রতি সেই একই প্রসঙ্গ নিয়ে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন সাংবাদিক-লেখক মিলন দত্ত। যেকোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক কি নিস্পৃহ থাকতে পারেন তাঁর এই মিলনের আহ্বানে—‘‘ তবে বর্ণমালা শিক্ষা থেকে শুরু করে যাবতীয় শিশুপাঠ্য বইয়ে হিন্দুদের আধিপত্য কিংবা বলা ভালো মুসলমানের অনুপস্থিতি বাঙালি মুসলমানকে চিরকাল ব্যথিত করেছে, আরও অভিমানী করে তুলেছে। কিন্তু শিক্ষায় এবং সংস্কৃতিতে অনেকটা এগিয়ে থাকা হিন্দুরা মুসলমানের সেই ব্যথা বা অভিমান বোঝার চেষ্টা করেনি কোনো দিন। এমনকী দেশভাগের পরেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু তা গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। আমাদের প্রাইমারে আজও রাম, শ্যাম, গোপাল, পার্থ, অর্ক বা ষষ্ঠীদের আনাগোনা। সেখানে নাসিম, নিয়াজ, তৌফিক, আঞ্জুমন বা আব্দুল্লারা আনুবীক্ষণিক সংখ্যালঘু এবং নিতান্ত প্রান্তিক হয়েই থেকে গেল। এখনও কোনো প্রাইমারে পড়ছি, ‘হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দেখি দিদিমা দীপ হাতে পুজোর আরতি করছেন।’ তারই পাশাপাশি ‘হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দেখি নানি দাওয়ায় জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের নামাজ পড়ছেন।’—এইরকম একটা পাঠ থাকলে কি বাঙালি শিশুকে খুব অসুবিধায় ফেলা হত? ’’ ( মুসলমানের বর্ণপরিচয়, আরেক রকম, জুন ২০১৩) একশো বছর আগে ভাষাবিদ যে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন সেটি যে আজও অধরা, তারই বিষাদ গেঁয়েছেন বর্তমানের সংখ্যালঘু সমাজ বিষয়ের অন্যতম বিশেষজ্ঞ মিলন দত্ত। তাঁর নিবন্ধে বর্তমানে প্রাইমারি স্কুলের সরকারি প্রাইমারে পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই বইগুলোতে অন্তত নামের ক্ষেত্রে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে সেটি নিয়ে কয়েকটা লাইন লেখা খুব জরুরি ছিল। শহীদুল্লাহর প্রশ্ন তোলার আগেও এবিষয়ে লেখালেখির নিদর্শন বিরল নয়। ‘বাসনা’ পত্রিকার ২য় ভাগ, ২য় সংখ্যায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩১৬) মোহম্মদ ফকিরউদ্দিন সরকার লিখছেন, ‘‘প্রথম বর্ণ পরিচয় কাল হইতেই আমাদের বালকগণ রামের গল্প, শ্যামের কথা, হরির কাহিনি, কৃষ্ণের চরিত্র ইত্যাদি পড়িতে থাকে। যদু-মধু, শিব-ব্রহ্মা, রাম-হরি ইত্যাদি নামের পাঠ আরম্ভ করিতে হয়। কাজেই আমাদের কোমলপ্রকৃতি শিশুগণ বিদ্যালয় পঠিত হিন্দুগণের উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হয় এবং আমাদের জাতীয় পবিত্র শাস্ত্র ও ইতিহাস উপাখ্যান ধর্মকর্মাদির বিষয় অপরিজ্ঞাত হইয়া থাকে।’’ অভিযোগের সারবত্তা যাই হোক না কেন মুসলমানদের তরফে শিশুশিক্ষা-সহ পাঠ্য বইয়ে তাঁদের নামধাম, ইতিহাস ঐতিহ্যের শুন্যতা নিয়ে একটা সঙ্গত অভিমান, একটা শুভ প্রত্যাশা বহুকাল ধরেই বিদ্যমান। কিন্তু আরো একটা বিষয়ও ভাবা দরকার হিন্দু লেখকদের পাশাপাশি মুসলিম লেখকরাও কেন প্রাইমার রচনায় এগিয়ে আসেননি ? পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত আশীষ খাস্তগীর সম্পাদিত ‘বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ ১৮১৬-১৮৫৫’ গ্রন্থে শিশুসেবধি-২-সহ ভিন্ন ভিন্ন ভাগ ও সংস্করণের বর্ণমালা, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় এবং শিশুবোধক সন্নিবিষ্ট। দুর্ভাগ্যবশত এই সংকলনে মুসলিম রচিত একটিও প্রাইমার নেই। তথ্য হিসেবে স্বীকার করতেই হয়, বাংলা প্রাইমার রচনায় খ্রিস্টান ও হিন্দু লেখকদের তুলনায়  মুসলমান লেখক বেশ কম। ‘জ্ঞানশিক্ষা-১’ নামের এক বারো পৃষ্ঠার বইয়ের লেখক ছিলেন মহম্মদ জুহুরুদ্দিন। সেরকম আরও কয়েকজন হলেন—‘প্রথম শিক্ষা’ ( মুনসি কাজিমুদ্দিন, ১৮৮৫), ‘প্রথম ভাগ বর্ণবোধ’ ( মজহরুল্লা কাজি, ১৮৮৬), ‘বর্ণশিক্ষা প্রথম ভাগ’ ( মহম্মদ আবদুল মজিদ সরদার, ১৮৮৮), ‘অক্ষর পরিচয়-১’ ও ‘অক্ষর পরিচয়-২’ ( ফতে মণ্ডল, ১৮৮৮), ‘সরল শিক্ষা’ ( ওয়াজুদ্দিন আহমেদ, ১৮৮৯)। এছাড়াও ওই শতাব্দীর আরও কয়েকজন লেখক হলেন—রহিমুদ্দিন সরকার,    মালেকউদ্দিন আহমেদ, মুনশি জমারত হুসেন, অর্পণ-উল-মুনসি। এই তালিকায় একমাত্র মহিলার নাম হালিমন্নেষা খাতুন। পরিচিত মুসলিম লেখক হিসেবে প্রাইমার রচনার পথিকৃৎ মীর মশাররফ হোসেন। তাঁর ‘মুসলমানের বাঙ্গলা শিক্ষা’-র প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ যথাক্রমে ১৯০৩ ও ১৯০৮-এ প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেটি হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজেই সেভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এর সবচেয়ে বড় কারণ অত্যধিক ধর্মীয় অনুষঙ্গ। ‘বাংলার চারশো বছরের প্রাথমিক শিক্ষা’ গ্রন্থের বাংলাদেশী লেখক রাহমান চৌধুরী লিখেছেন-- ‘‘ ‘মুসলমানের বাঙ্গলা শিক্ষা প্রথম ভাগ’ বইটির আরম্ভ হয়েছে, ‘আল্লা এক। আল্লা সকলের বড়। আল্লার কোনো দোষ নাই। কোনো বদনাম নাই’। বইটির অন্যত্র আছে, ‘তুমি মুসলমান?  টুপি নাই কেন?’ বইটিতে গুরু-শিষ্যের সংলাপ রয়েছে এইরকম— গুরু : বেহেস্ত কি ? শিষ্য : বেহেস্ত অতি সুশ্রী আরামের বাসস্থান। খুব পরিষ্কারভাবে বইটির লেখক বালকদের ভাষা শিক্ষা বা লেখাপড়া শিক্ষা দেয়ার চেয়ে ধর্মীয় উপদেশ দেয়ার চেষ্টা করেছেন।’’ তাঁর মতে, হিন্দুদের রচিত গ্রন্থ মুসলমানদের জন্য কী ধরণের সমস্যা সৃষ্টি করেছিল সেটাকে মূল্যায়ন না করে মশাররফের পথ ভুল ছিল। হিন্দুরা বর্ণশিক্ষা রচনার ক্ষেত্রে মুসলমানদের সংস্কৃতিকে একেবারেই গ্রন্থে স্থান দিতে পারেননি। কিন্তু মশাররফ হোসেন যে বই লিখেছেন, সেই পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান হয় না। ব্যতিক্রমী গবেষক পরমেশ আচার্য লিখছেন, ‘সন্দেহ নেই যে, উনিশ শতকের পুরোধারাই মূলত বাংলা গদ্যসাহিত্য ও বাংলার আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার বিষয় ও বাংলা সাহিত্যে হিন্দু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গভীর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।’ বাঙালির প্রাইমারের তালিকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকরী দুটো বইয়ের নাম, বর্ণপরিচয় ও সহজপাঠ। উল্লেখ্য, প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্য বই হল প্রাইমার। প্রাইমারের মধ্যে দিয়ে শিশু তার মুখ উচ্চারিত ধ্বনি আর বর্ণের সম্পর্ক বুঝতে পারে। সুখকর না হলেও এটা সত্য বর্ণপরিচয়-এ মুসলিম নামধাম ও অনুষঙ্গের চিহ্নমাত্র নেই। সহজ পাঠের প্রকাশকাল ১৯৩০। অবিভক্ত বাংলায় হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেশি তখন। ১৯২৬-এ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। সেই সময়কালে মুসলিম কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ ও বিদ্বজন আগের তুলনায় স্বাভাবিকভাবে বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু বিষাদেরই কথা সহজপাঠের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ মিলে মাত্র দুটি নাম—জয়নাল এবং তমিজ মিঞা। তবুও ‘জয়নাল ধরে হাল’ এবং ‘আমি যে রোজ সকাল হ’লে/ যাই শহরের দিকে চ’লে/তমিজ মিঞার গরুর গাড়ি চড়ে’—পড়ে আমরা সকলেই হই শিহরিত।
.
আমার বই এবং আমাদের পরিবেশ
------------------------------
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তর প্রকাশিত ‘আমার বই’ এবং ‘আমাদের পরিবেশ’ বই দুটি রাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যথাক্রমে প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্য। বই দুটির সার্বিক মূল্যায়ন নয় কেবলই পুরো সমাজের ছেলেমেয়েদের নাম বইয়ে কিভাবে ও কতোটা জায়গা পেয়েছে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে আগ্রহী আমরা। প্রথমে আলোচ্য ‘আমার বই’। ‘ছুটির মজা’ শুরু হল, শরৎ এসেছে দিয়ে। মাঝে আছে—‘চারিদিকে দুগ্গা পুজো আর ইদের ছুটি। সবাই মাতোয়ারা।’ (পৃষ্ঠা ২৮১) দুর্গা পুজোর পাশেই ইদ থাকায় বাঙালির বড়ো দুটো উৎসব নিয়ে জানা হয়ে যায়। এলোমেলো কথাকে সাজিয়ে লেখার পাঁচটি বাক্যে পেলাম পাঁচটি নাম—রহিম, পাঁচু, আসিফ, টুনু এবং চাঁদু।(পৃষ্ঠা ২৮৯) সাধারণ যোগ অনুচ্ছেদে দু-জনের মধ্যে সম্পর্কের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে : হিরু ও দাদা, হীরা ও ভাই এবং আসিফ ও চাচা, ফুফু।(পৃষ্ঠা ২৯৫) ‘ছোটো রবি, ছোটোদের রবি’ রচনায় কবিগুরু নিয়ে আছে শিশুদের উপযোগী আকর্ষণীয় বর্ণনা। বড়ো হয়ে তিনি বোলপুরে বেশি থাকতেন। সেখানে ছোটদের স্কুল তৈরি করেন। তিনি পড়াতেন সেখানে। ছোটদের জন্য তিনি অনেক বই লেখেন। সহজপাঠ বইটিও তিনি লিখেছেন (পৃষ্ঠা ৩০৭)। কয়েক পৃষ্ঠার পর ‘নুরু থেকে নজরুল’-এ লেখা হল, ‘যা পেত তাই সে পড়ত। পাঁচালি হোক কোরান।’ (পৃষ্ঠা ৩১৪) কোরান নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা সামান্য কয়েকটি শব্দ যোগ করলে সারাজীবনের জন্য মুসলমানের ধর্মগ্রন্থ নিয়ে অপরিচয় দূর হয়ে যায়। একটু বড় হলে, তারা তখন পড়বে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের নাম--গীতা, কোরান, বাইবেল, ত্রিপিটক প্রভৃতি। ‘বাজারে কেনাবেচা, নানারকম নোট’-এ বিভিন্ন মূল্যমানের টাকা দিয়ে কেনাবেচার পাঠে ক্রেতা ও বিক্রেতার নাম এবং তাঁর সঙ্গে সম্পর্কে আপামর বাংলাই প্রতিফলিত। যেমন, মাছ বিক্রেতা অধীর মামা ও ক্রেতা রানি পিসি, ফুলকপি বিক্রেতা আয়ুব চাচা ও ক্রেতা জয়নাল দাদা এবং বেগুন বিক্রেতা সীমাদি ও ক্রেতা হীরক।(৩২৮ পৃষ্ঠা) উপরে উল্লিখিত ওই একই নামের অনুচ্ছেদে পেলাম : কাঁচাকলা বিক্রেতা দিলু কাকা ও ক্রেতা টিপাই, আলু বিক্রেতা কামাল ভাই ও ক্রেতা হেনা আপা। এছাড়াও আরও দুটো নাম আছে শিলা ও বিলু যারা হাট থেকে যথাক্রমে চপ ও কাঠিগজা কিনেছে।( ৩৩৩ পৃষ্ঠা ) ‘নীলময়ূরের পালক’ নামের  রূপকথার গল্পে দুই বন্ধু হিসেবে আবির ও রহমান বাঙালিত্বের দ্যোতক (পৃষ্ঠা ৩৪১)।
আগেই উল্লিখিত ‘আমাদের পরিবেশ’ বইয়ে রিনা-আমিনার গলাগলি   রবীন্দ্র-নজরুলের বাংলার চিরকালীন বন্ধনের অনুপম উদাহরণ। ‘আমাদের গ্রাম’ কবিতায় বন্দে আলি মিয়া যেন সে কথাই বলেন: ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই/ এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।’ প্রথম পৃষ্ঠার  ‘রোজ বিকেলে নানা খেলা’-য় যথাক্রমে বিমল, তিতলি, হামিদ, রিনা, বীণা, আমিনা, সাবিনা-দের ছাত্র-ছাত্রীরূপে যৌথস্বর বেশ মোলায়েম, আরামপ্রদ। ‘ঠিকঠাক খেলা আর ঠিকমতো শোনা’-য় কথোপকথন শুরু করল রিনা। পরপর তাতে যোগ দেয় আমিনা, সীমা, বিশু, দিলীপ, নিশা।(পৃষ্ঠা ৩) ‘গা, হাত, পায়ের যত্ন’ পাঠে রবীন, আমিনা, রিনা, ঋজু, অসীম, দিলীপ, হেনা, জুলেখার সহপাঠীদের সঙ্গে আলাপনে পল্লী বাংলা চিত্রিত।(পৃষ্ঠা ৪-৫) আমরা জানি হজরত ঈশা অর্থাৎ যিশুখ্রিস্ট্রের মায়ের নাম মরিয়ম। সেই মরিয়ম দিয়েই শুরু ‘ইন্দ্রিয়দের সাড়া, সহজে বুঝতে পারা’ পাঠ। মরিয়ম সামান্য একটু ডগাসহ গোলাপ ফুল এনেছে। সেই ফুলের সৌরভে মরিয়মের কাছে একে একে হাজির হচ্ছে জিয়ানা, দিলীপ, হিমু, রিক্তা, তিতলি। দিদিমণি অবশ্য গোলাপ ও গোলাপের ডগার কাঁটা নিয়ে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলছেন।(পৃষ্ঠা ১২-১৩)  ‘অনেকরকম শাকসবজি’ প্রসঙ্গে অন্যের প্রশ্ন ফুলকপিটা ফুল না কুঁড়ি শুনে সমীরের উত্তর—কুঁড়ি। সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজকলি নিয়ে প্রশ্ন করে রেবা এবং শিম নিয়ে রিম্পা। তাদের সঙ্গী হয় সম্পৎ, আয়েষা, তুতাই, টিপাই, ফতেমা, মঙ্গলা, সাগিনা, বৈশাখী, কালু, রমজান, দিলীপ, রীতা।(পৃষ্ঠা ৩১) ‘প্রাণীজ খাবার’ বোঝাতে গিয়ে মাছ, ডিম, মুরগীর মাংসের ঠ্যাং, একটি গরু ও তার পাশে এক পাত্রে দুধের ছবি আছে। রমেশ ডিম খেতে ভালোবাসে কিন্তু লুতফার পছন্দ মাছ। ডমরু মাংস পেলে আর কিছু চায় না কিন্তু তাপসের অভ্যেস শেষপাতে দুধ-ভাত। আর আকবরের সর্দি-কাশির ধাত তাই তার মা তাকে রোজ সকালে মধু খাওয়ায়।(পৃষ্ঠা ৩৯) মনে পড়ল, আমরা ছোটবেলায় গরু রচনায় প্রায়ই পড়তাম, হিন্দুরা গরুকে দেবতার মতো পূজা করে। বাড়ির ও পরিবেশের প্রভাবে জেনেছিলাম, আমরা গরুর মাংস খেলেও বৈশাখী, দিলীপ, রমেশরা খেত না। কিন্তু বর্তমান বইয়ে সুন্দরভাবেই প্রানীজ খাদ্য ডিম, মাছ, মাংস, দুধ উল্লেখ করা হলেও ভারসাম্য রক্ষিত হয়েছে। ‘পোশাক’ অধ্যায়ে আমরা পাচ্ছি কেতকী, আয়েষা, আসিফ, বৈশাখী, রেহানা, ইমরান, রবিলাল, তিয়ান, রিয়াজ প্রমুখের নাম।(পৃষ্ঠা ৫৮-৫৮) ‘ঘরবাড়ির যুক্তি-তর্ক’ অনুচ্ছেদে জেকব তার প্রশ্ন নিয়ে হাজির। তার সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেয় তনয়া, ডমরু, সাহিল, আমিনা, সাইনা। (পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮) ‘পবিবার’ অধ্যায়ের সুমনা ও সানিয়ার প্রসঙ্গ আগেই আলোচিত হয়েছে। ‘চিঠি পাওয়ার আনন্দ’ পাঠে দেখা যাচ্ছে, কেতকী ও টিকাই স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ডাক-পিয়ন কেতকীকে তার ছোট পিসির লেখা একটা চিঠি দেয়। চিঠিতে ঠিকানা লেখা থেকে পিনকোড সবই গল্পচ্ছলে শেখানো হয়েছে। পরের পৃষ্ঠায়   কেতকীকে পাঠানো পোস্টকার্ডের ছবি মুদ্রিত। সেখানে লেখা : প্রতি, কেতকী হেমব্রম, প্রযত্নে: হাম্বির হেমব্রম এবং প্রেরক হিসেবে কেতকীর পিসির নাম নন্দিনী হেমব্রম (পৃষ্ঠা ১০১-১০২)। পাঠ্য বইয়ে আদি বাসিন্দাদের উল্লেখ সাধারণত দেখা যায় না। সেদিক দিয়ে এই উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। ‘আকাশ’ অধ্যায়ের  ‘তারায় তারায় আলোর নদী’ শিরোনামের পাঠে স্টিফেন দেখল তারা সরে যায়। আলিও তার এই কথার সঙ্গে একমত হয়। বিশাখার কিন্তু বিশ্বাস হয় না স্টিফেন ও আলির কথা। দিদিমণি তাদের এবিষয়ে বলে দেন। দিদিমণির পড়ানোতে  ছিল জেমস ও অপূর্বও। (পৃষ্ঠা ১২০) ‘সম্পদ অধ্যায়’-এর ‘ হরেকরকম শিল্পকথা’ এক জরুরি পাঠ্যাংশ। ইটখোলার পাশ দিয়ে যায় স্বপন এবং ইলিয়াস থাকে চালকলের পাশে। দিদিমণির কথায় স্বপন, ইলিয়াস, অর্ণব বুঝতে পারে এগুলো ঘরোয়া শিল্প নয়, একটু বড় শিল্প ( পৃষ্ঠা ১৪৩)। তাহলে ঘরোয়া শিল্প কোনগুলি? রাবেয়াদের ঘরের ঢাকনা দেওয়া ফুল কাটা ঝুড়ি, তুহিনদের ঘরে ঝিনুক। 

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শেরপুর: ইতিহাস ও বর্তমানের এক হৃদয়ছোঁয়া গল্প

শেরশাহবাদিয়া ভাষা: বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপ না কি ভিন্ন একটি লোকভাষা?

সাবান। কোনটা কি ধরনের। সরকারি নির্দেশনামাতে সাবান সম্পর্কে কি বলা আছে জানতে পড়ুন...